পুজো

জেনে নিন মকর সংক্রান্তি-র ইতি-বৃত্তান্ত!

মকর সংক্রান্তির উত্‍সবটি সূর্যের উপর ভিত্তি করে এবং পঞ্জিকা গণনার ভিত্তিতে পালিত হয়। কথিত আছে যে সূর্য যখন মকর রাশিতে প্রবেশ করে তখন মকর সংক্রান্তি পালিত হয়। এই বছর সূর্য মকর রাশিতে ১৪ জানুয়ারী, ২০২৩ এ রাত ৮ টা ২১  মিনিটে গমন করছে। কিন্তু রাতে স্নান করা হয় না, তাই এ বছর উদয় তিথি বিবেচনা করে মকর সংক্রান্তি পালিত হবে ১৫ জানুয়ারি। এই দিনে দান করলে শুভ ফল পাওয়া যায়। শাস্ত্র অনুসারে, মকর সংক্রান্তিতে দান ছাড়াও অন্য কিছু কাজ করাও নিষেধ। আসুন জেনে নিই মকর সংক্রান্তির দিনে কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নয়। মকর সংক্রান্তির দিনে পবিত্র নদীতে স্নান করলে পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং মোক্ষ লাভ হয়। গঙ্গাস্নান শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়। গঙ্গায় স্নান করতে না পারলে বাড়িতে স্নানের জলে গঙ্গা জল মিশিয়ে স্নান করুন। মকর সংক্রান্তিতে সূর্য দক্ষিণায়ন থেকে উত্তরায়ণে যায়। এমতাবস্থায় সূর্য উদয়ের সময় সূর্য পুজোর গুরুত্ব বেড়ে যায়। এই দিনে সূর্য দেবতার বিশেষ পুজোর পর জলে লাল চন্দন সিঁদুর ও কালো তিল মিশিয়ে সূর্যদেবকে অর্ঘ্য নিবেদন করুন। এর দ্বারা, ভগবান সূর্যের কৃপায়, আপনি গৌরব, খ্যাতি এবং শক্তি পাবেন। এদিন শাস্ত্র মতে মকর সংক্রান্তিতে দান করলে বিশেষ ফল পাওয়া যায়। কথিত আছে যে এই দিনে করা দান সরাসরি ঈশ্বরকে উৎসর্গ করা হয়। এমতাবস্থায় মকর সংক্রান্তিতে ব্রাহ্মণ, দরিদ্র ও অভাবীদের দান করা উচিত। এই দিনে দান করলে সমাজে সম্মান ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। শাস্ত্র মতে, মকর সংক্রান্তির দিনে সিগারেট, মদ, গুটকা ইত্যাদি কোনো ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করা উচিত নয়। এছাড়াও, এই দিনে মশলাদার খাবার খাওয়া উচিত নয়। মকর সংক্রান্তির দিন গঙ্গা বা অন্য কোনো নদীতে স্নান ও দান করার পরই কিছু খাওয়া উচিত। এই দিনে তিল ও মুগ ডালের খিচুড়ি খাওয়া ভালো বলে মনে করা হয়। মকর সংক্রান্তির দিন যদি কোনো ভিক্ষুক, সন্ন্যাসী, বৃদ্ধ বা অসহায় ব্যক্তি আপনার বাড়িতে আসে, তাকে অপমান করবেন না এবং তাকে খালি হাতে বাড়ি থেকে বের হতে দেবেন না। আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে দান করুন। সারা দেশ জুড়ে বিভিন্ন নামে পালিত হয় মকরসংক্রান্তি। চলুন জেনে নেওয়া যাক, দেশের কোথায় কী নামে পালিত হয় মকরসংক্রান্তি। —

১)পশ্চিমবঙ্গে পৌষ সংক্রান্তি হল বাংলা মাস পৌষের শেষ দিন। বাংলায় ফসল কাটার উৎসব হিসেবে চিহ্নিত এই দিনটি। পৌষ সংক্রান্তিতে বাঙালিরা ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে। কৃষক পরিবারে ধানের ফুলের পেস্ট দিয়ে আলপনা আঁকা হয়। কোথাও কোথায়ও আমের পাতার ছোট গুচ্ছ এবং ধানের ডাঁটা ঝুলিয়ে লক্ষ্মীকে স্বাগত জানায়। সঙ্গে পিঠে-পুলি তো আছেই।

২) মাঘ বিহু হল অসম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অংশে পালিত ফসল কাটার উৎসব, যা মাঘ মাসে ফসল কাটার মরসুমের সমাপ্তি চিহ্নিত করে। ফসল কাটার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি এবং অগ্নিদেবতার কাছে প্রার্থনার জন্য একটি মেজি বা বনফায়ার জ্বালানো হয়। ঘরে ঘরে তৈরি হয় শীতের মিষ্টি।

৩) সিকিমে মাঘে সংক্রান্তি হল একটি নেপালি উৎসব যা ইয়েল ক্যালেন্ডারে মাঘ মাসের প্রথম তারিখে পালন করা হয়। শীতকালীন অয়নকালের সমাপ্তি ঘটে। থারু সম্প্রদায় এই বিশেষ দিনটিকে নতুন বছর হিসেবে উদযাপন করে।

৪) বিহারে টিলা সকরত বা খিচড়ি বা দই চুড়া নামে এই প্রথা চলে। দু দিন ধরে চলে উদযাপন। বিহার ও ঝাড়খণ্ডে দুই রাজ্যেই এটা সংঘটিত হয়। সকালে নদীতে পবিত্র স্নান সেরে মেজি বা বনফায়ার জ্বালানো হয়। তাতে তিলের বীজ দেওয়া হয়। ঝাড়খণ্ডের কিছু অংশে একে টুসু পরবও বলা হয়।

৫)ওড়িশায় মাকারা চাউলা নামে সংক্রান্তি পালিত হয়। ওড়িশায় লোকেরা এই সময় চিনি, কলা, নারকেল এবং ‘মাকারা চাউলা’ নামে বিশেষ এক ধরনের কালো মরিচ দিয়ে বিশেষ ধরনের একটি মিষ্টি ভাত তৈরি করে। কোনার্ক সূর্য মন্দিরে হাজার হাজার ভক্ত সূর্য দেবতার পুজো করেন।

৬) তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশে পেদ্দা পান্ডুগা নামে পালিত হয়। মকরসংক্রান্তি হল অন্ধ্র ও তেলেঙ্গানা জুড়ে পালিত ৪ দিনের উৎসব। প্রথমদিন ভোগী, মকর সংক্রান্তি দ্বিতীয়দিন, তৃতীয়দিন কানুমা এবং মুক্কানুমা চতুর্থ দিন। ‘পেদা পান্ডুগা’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল বড় উত্সব। যেখানে নতুন পোশাক কেনা হয়। প্রার্থনা জানানো হয়। বাড়িতে অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।

৭) আবার তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল নামে পালিত হয়। সাধারণত সূর্যের কক্ষপথের উপর নির্ভর করে তামিলনাড়ু এবং শ্রীলঙ্কায় ‘পোঙ্গল’ পালিত হয়। উত্সবটি সূর্যকে উদ্দেশ করে পালিত হয়। পোঙ্গল উত্সবের ৩টি দিনকে যথাক্রমে ভোগী পোঙ্গল, সূর্য পোঙ্গল এবং মাত্তু পোঙ্গল। তামিলদের মধ্যে কেউ কেউ আবার কানুম পোঙ্গল নামে পরিচিত পোঙ্গলের চতুর্থ দিনটিও উদযাপন করে। জনপ্রিয়ভাবে তৈরি করা থালা থেকে এই পোঙ্গল নামটি এসেছে, যার অর্থ “ফুটানো” বা “ওভারফ্লো”।

৮) কেরালাতে মাকারভিলাক্কু হল একটি বার্ষিক উৎসব যা মকরসংক্রান্তিতে কেরালায় শবরীমালার মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয়। উৎসবের মধ্যে রয়েছে তিরুভভরনম (ভগবান আয়াপ্পানের পবিত্র অলঙ্কার) শোভাযাত্রা এবং সবরিমালার পাহাড়ি মন্দিরে একটি ধর্মসভা। আনুমানিক অর্ধ মিলিয়ন ভক্ত প্রতি বছর এই দিনে শবরীমালা দর্শন করতে যান।

৯) কর্ণাটকে এই সময় ফসল কাটার উৎসবকে বলা হয় সুগ্গি। লোকেরা ‘এলু বিরোডু’ নামে একটি অনুষ্ঠান করে। সাদা তিলের বীজ ভাজা চিনাবাদাম, শুকনো নারকেল এবং গুড়ের সাথে মিশিয়ে আত্মীয়দের মধ্যে বিনিময় করা হয়।  

১০) গুজরাতে উত্তরায়ণ বা মকরসংক্রান্তি ১৪ জানুয়ারি উদযাপিত হয়। উত্তরায়ণে ওড়ানো হয় ঘুড়ি। আহমেদাবাদ থেকে ঘুড়ি ওড়ানো হয়।

১১) মহারাষ্ট্র এবং গোয়াতে মকর সংক্রান্তি বা মাঘী সংক্রান্ত উপলক্ষে হলদি কুমকুমের সমাবেশ প্রায় অর্ধেক মাস ধরে চলে। বাড়িতে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিবাহিত মহিলারা সুখী দাম্পত্য জীবনের চিহ্ন হিসাবে একে অপরকে হলদি-কুমকুম প্রয়োগ করে। ঐতিহ্যটি মহারাষ্ট্রে পেশোয়া শাসনের সময়কালের।

১২) মকরসংক্রান্তি উত্তরাখণ্ডে ঘুঘুটি বা কালে কাউয়া নামে পরিচিত। কুমায়ুন অঞ্চলে উদযাপন করা হয় এই উৎসবটি। উদযাপনটি ঋতু পরিবর্তন এবং পরিযায়ী পাখিদের ফিরে আসার ইঙ্গিত দেয়।

১৩) হিমাচল প্রদেশে মকরসংক্রান্তি মাঘ সাজি নামে পরিচিত। দিনটিতে মাটির পাত্রে ভাত রান্না করে ঘুড়ি ওড়ানো হয়।

১৪) পাঞ্জাবে এই সময় লোহরি কৃষকদের জন্য নতুন বছরকে চিহ্নিত করে। এই দিনে কৃষকরা প্রার্থনা করেন। ফসল কাটা শুরু হওয়ার আগে তাঁদের ফসলের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সেইসঙ্গে ভগবান অগ্নির কাছে প্রার্থনা করেন যাতে তাঁরা তাদের জমিকে প্রচুর পরিমাণে আশীর্বাদ করেন। 

১৫) মকরসংক্রান্তি কাশ্মীর এবং জম্মুর কিছু অংশে শিশু সায়েঙ্করাত হিসাবে পালিত হয়। এই দিনে সূর্য উত্তর গোলার্ধের দিকে যাত্রা শুরু করে এবং সেজন্য দিন বড় হতে শুরু করে এবং রাতগুলি ছোট। হবে। এটিকে জম্মুর কিছু অংশে মাঘি সংগ্রান্ডও বলা হয়।

১৬) মকরসংক্রান্তিতে উত্তর প্রদেশ এবং উত্তর ভারতের বিভিন্ন অংশে খিচড়ি পরব পালিত হয়। এই দিনে হাজার হাজার হিন্দু প্রয়াগরাজের সঙ্গমের বরফ জলে পবিত্র ডুব দেয়। যেখানে গঙ্গা, যমুনা এবং সরস্বতী নদী একসাথে এসে মিশেছে। ঘরে ঘরে খিচুড়ি রান্না হয়। খিচুড়ি রান্না করে সূর্য দেবতাকে নিবেদন করা হয়।

১৭) মকরসংক্রান্তিতে দিল্লি, হরিয়ানা ও রাজস্থানে ‘সকরাত’, মধ্যপ্রদেশে ‘সুকরাত’ হিসাবে পালিত হয়। উত্সবটি সূর্য দেবতাকে উদ্দেশ করেই পালিত হয়। সূর্যের কাছে প্রার্থনা জানানো হয়। তিল বীজ দিয়ে মিষ্টি তৈরি করে নিবেদন করা হয়।

গঙ্গাসাগরের মকর সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে সেজে উঠেছে কপিল মুনির মন্দির