পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব দিক থেকে এগিয়ে আসছে রাশিয়ার ফৌজ। লক্ষ্য ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ। পশ্চিম দিকের রাস্তাও বন্ধ। বৃহস্পতিবার রাতেই গোটা শহর ঘিরে ফেলা হয়েছিল। শুক্রবার সকাল হতে না হতে কিয়েভের প্রাণকেন্দ্রে আছড়ে পড়েছে একের পর এক রুশ ক্ষেপণাস্ত্র। বম্ব শেল্টারে বসেও কেঁপে উঠেছে পরিবারগুলি। শহরের রাস্তায় দেখা যায় মস্কোর ট্যাঙ্ক-সেনার। ইউক্রেন সেনার পোশাকে সাঁজোয়া গাড়িতে চড়েও তারা টহল দিচ্ছে। রাজধানীকে রক্ষা করতে বাসিন্দাদের কাছে কিয়েভ কর্তৃপক্ষের আর্জি—প্রস্তুত থাকুন মলোটভ ককটেল হাতে। যদিও যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বলছে, ইউক্রেনের পতন এখন সময়ের অপেক্ষা। দ্বিতীয় দিনেই কিয়েভের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে রুশ সেনা। রাজধানী থেকে মাত্র সাত কিমি দূরের একটি বিমানবন্দর তারা দখল করেছে। অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন ইউক্রেনের স্পেশাল ইউনিটের ২০০ জন। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই ফের রুশ সেনার পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা কিয়েভে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় হামলা করবে না। যদিও সকাল থেকেই শহরে শুরু হয় বোমাবর্ষণ। কিন্ডারগার্টেন এবং অনাথ আশ্রমেও হামলা চলেছে বলে অভিযোগ। গোপন বাঙ্কারে আশ্রয় নেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। তবে কিয়েভে ঢোকা থেকেই ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে মস্কোর ফৌজকে। কিয়েভ কর্তৃপক্ষের তরফে সাধারণ নাগরিকদের হাতে প্রায় ৪০ হাজার মেশিন গান ও রকেট লঞ্চার তুলে দেওয়া হয়েছে। সেনা-জনসাধারণের যৌথ প্রতিরোধে কিছুটা হলেও থমকেছে রুশ আগ্রাসন। গতকালই চেরনোবিলের পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দখল নিয়েছে মস্কো। ইতিমধ্যেই সেখানে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে বলে দাবি ইউক্রেনের পরমাণু সংস্থার। আতঙ্ক বাড়ছে গোটা ইউরোপে। ইউক্রেন ছেড়ে পালাচ্ছেন সাধারণ মানুষও। হাঙ্গেরি সীমান্তে পাঁচ কিমি লম্বা গাড়ির লাইন চোখে পড়েছে। ইতিমধ্যে রাশিয়ার আক্রমণে ইউক্রেনে ৫৭ জন সাধারণ নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। ৪৫০ জন রুশ সেনার মারা যাওয়ার খবরও মিলেছে। সংখ্যাটা প্রায় আড়াই হাজার বলে দাবি ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর।
এদিন বেলা গড়াতেই মস্কোর দিক থেকে আসে আলোচনার প্রস্তাব। যদিও ভ্লাদিমির পুতিনকে সেব্যাপারে রাজি করান চীনা প্রেসিডেন্ট জি জিনপিং। ফোনে তাঁর পরামর্শ ছিল, ঠান্ডা যুদ্ধের মানসিকতা ছাড়ুন। পুতিনও জানান, তিনি এই প্রস্তাবে সম্মত। বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে দু’পক্ষের আলোচনা হতে পারে। তার জন্য প্রতিনিধি দল পাঠাতে প্রস্তুত রাশিয়া। পরে ইউক্রেন সেনাকে সেদেশে অভ্যুত্থানের পরামর্শ দেন পুতিন। তিনি বলেন, নিও-নাৎসিদের হাত থেকে আপনাদের স্ত্রী-পুত্রদের বাঁচাতে ক্ষমতা দখল করুন। তাঁর মতে, এতে সমঝোতায় সুবিধা হবে। বিকেলে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদামির জেলেনস্কিও এক ভিডিও বার্তায় জানান, ‘আমি রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাই। মানুষের মৃত্যু বন্ধ করতে আসুন আলোচনার টেবিলে বসি।’ অনেক রাতে প্রেসিডেন্ট বিল্ডিংয়ের বাইরে আরও একটি ভিডিও বার্তায় জেলেনস্কি বলেন, দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় মরণপণ লড়াই চালিয়ে যাব। রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরোধিতা করলেও বিধ্বস্ত ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ায়নি প্রায় কোনও দেশই। ন্যাটো পর্যন্ত নীরব। এদিন সকালেই তা নিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন জেলেনস্কি। সাফ জানান, ‘বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো দূর থেকে কেবল সব কিছু দেখে যাচ্ছে। ওদের প্রথম টার্গেট আমি। তারপর আমার পরিবার। কিন্তু আমি রাজধানী ছেড়ে যাব না।’ জেলেনস্কি এও বলেছেন, আমি ইউরোপের ২৭ জন নেতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ইউক্রেনকে কি ন্যাটো-তে রাখা হবে, আমি তাঁদের সরাসরি এই প্রশ্নের জবাব জানতে চেয়েছিলাম। সবাই ভয় পাচ্ছেন, উত্তর দেননি। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, আমাদের পাশে কেউ নেই। কে আমাদের হয়ে যুদ্ধ নামতে প্রস্তুত? সত্যি কথা বলতে কী, আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। ন্যাটোর সদস্যপদের ব্যাপারে কে ইউক্রেনকে গ্যারান্টি দেবে? সত্যি কথা বলতে কী, সবাই ভীত। রাশিয়ার মোকাবিলার ব্যাপারে ইউক্রেনকে একা ছেড়ে দেওয়ার জন্য পশ্চিমী দেশগুলির নেতৃত্বকে দায়ী করে ভলোদিমির জেলেনস্কি শুক্রবার বলেছেন, তিনি রাশিয়ার আক্রমণ থামাতে আলোচনার পথে যেতে ভীত নন। কিন্তু এরজন্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত গ্যারান্টি প্রয়োজন।