দেবী পার্বতী এবং দেবাদিদেব মহাদেবের পুত্র কার্তিক হলেন দেব সেনাপতি। কার্তিক হলেন পৌরাণিক দেবতা। অনেকে বিশ্বাস করেন, দেব সেনাপতি কার্তিকের আরাধনায় পুত্রসন্তান লাভ হয়। কার্তিকের আরাধনায় শুধু যে পুত্র লাভ হয় তা-ই নয়, এই পুজো করার ফলে ধন এবং সংসারের শ্রীবৃদ্ধিও হয়। অর্থাৎ সংসারের সদস্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধনসম্পত্তিরও বৃদ্ধি ঘটে। কার্তিক পুজো করার ফলে সংসারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন সফলতা প্রাপ্ত হয়, আয় বৃদ্ধি এবং উন্নতি হয়। কার্তিকের সঙ্গে বীরত্বের সম্পর্ক থাকার কারণে দেব সেনাপতির আরাধনায় যশ এবং বল লাভ হয়। জ্যোতিষশাস্ত্র মতে কার্তিকের আরাধনা করার ফলে মঙ্গল গ্রহের সুফল প্রাপ্ত হয়। তাই মঙ্গলগ্রহের অবস্থান ভালোর দিকে রাখার জন্য অনেকেই কার্তিক পুজো করে থাকেন। প্রসঙ্গত, সূর্য যখন রাশি পরিবর্তন করে তুলা থেকে বৃশ্চিক রাশিতে যায়, তখনই কার্তিক মাসের শেষ দিনে কার্তিক পুজো করা হয়। দেখা যাক, কার্তিক পুজোর সময় ক্ষণ। কার্তিক পুজো সূর্যের গতির উপর নির্ভরশীল। সূর্য যখন রাশি পরিবর্তন করে তুলা থেকে বৃশ্চিক রাশিতে যায় সেই দিন অর্থাৎ কার্তিক মাসের শেষ দিন কার্তিক পুজো করা রীতি। আগামী ১৬ নভেম্বর সকাল ৭টা ৩২ মিনিটে (প্রায়) সূর্য রাশি পরিবর্তন করে তুলা রাশি থেকে বৃশ্চিক রাশিতে গমন করবে।
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুসারে কার্তিক পুজো –
বাংলা– ৩০ কার্তিক, শনিবার। ইংরেজি– ১৬ নভেম্বর, ২০২৪ শনিবার।
গুপ্তপ্রেশ পঞ্জিকা মতে –
বাংলা– ৩০ কার্তিক, শনিবার। ইংরেজি– ১৬ নভেম্বর ২০২৪, শনিবার।
এই মাসব্যাপী আকাশ দীপদান করা হয় । এই ‘আকাশ প্রদীপ’ কয়েক বছর আগেও কার্তিক মাসে বাংলার ঘরে ঘরে জ্বলে উঠত। এখন অবশ্য আধুনিকতার ছোঁয়ায় লোকাচার যেন হারিয়ে যাচ্ছে। তবুও গ্রাম বাংলায় কার্তিক মাসের হালকা শীতের চাদর মোড়ানো সন্ধ্যায় সন্ধান পাওয়া যায় ‘আকাশ প্রদীপ’ এর। পুরাণ মতে , দীর্ঘ চার মাসের যোগনিদ্রা শেষে, কার্তিক মাসে জেগে ওঠেন ভগবান বিষ্ণু। তাঁকে প্রসন্ন রাখতে, ভক্তরা কার্তিক মাসের প্রথম দিন থেকে সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত, প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় মাটির প্রদীপ ঘি বা তেল দিয়ে জ্বালিয়ে রাখেন। বাড়ির সব থেকে উঁচু স্থানে উত্তর অথবা পূর্ব দিকে মুখ করে রেখে এই প্রদীপ জ্বালানো হয়। লাঠির ডগায় ছাদের উপরেও এই প্রদীপ দিতে দেখা যায়। বর্তমান সময়ে প্রদীপের বদলে বৈদ্যুতিক বাতিও দেন অনেকে। বিশ্বাস, ভক্তদের আকাশ প্রদীপ অর্পণে সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান বিষ্ণু তাঁদের মনস্কামনা পূরণ করেন। সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধিতে ভরে ওঠে ভক্তদের জীবন। আরোগ্য ও আশীর্বাদ প্রদান করেন ভগবান বিষ্ণু। অন্য একটি কিংবদন্তি মতে, আশ্বিন মাসের মহালয়ার দিন পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করা হয়। তার পরের একটি মাস তাঁরা আনন্দ উৎসবে সামিল হন এবং পরলোকের উদ্দেশ্যে গমন করেন কালী পূজার অমাবস্যায়। এই প্রদীপ জ্বেলে আবাহন করা হয় পিতৃলোকে, প্রেতলোকে অবস্থান করা পূর্বপুরুষদেরও। যাতে তাঁরা আকাশ প্রদীপের আলোয় পথ চিনে আশীর্বাদ দিতে আসতে পারেন উত্তরসূরীদের। প্রদীপ হিন্দু ধর্মের যে কোনও অনুষ্ঠানের সব থেকে অপরিহার্য এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ধর্মীয় আচার, রীতি সবকিছুই সম্পন্ন হয় প্রদীপের দ্বারা। ভগবান বিষ্ণুর বন্দনা করতে তাই বেছে নেওয়া হয়েছে ‘আকাশ প্রদীপ’। ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে সমর্পিত এই প্রদীপের ধরন আলাদা আলাদা হয় এবং তা ভক্তদের নানা মনোবাসনা পূরণের লক্ষ্যে জ্বালানো হয়। একনজরে আমরা দেখে নিই আকাশ প্রদীপের ধরন গুলি। এই প্রদীপ আসলে দেহেরই প্রতীক। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম- এই পঞ্চভূতে যেমন তৈরি হয় এই নশ্বর শরীর, মাটির প্রদীপটিও তাই! ক্ষিতি বা মাটি তার কায়া তৈরি করে। অপ বা জলে তা আকার পায়। তেজ বা আগুন আত্মার মতোই স্থিত হয় তার অন্তরে। মরুৎ বা হাওয়া সেই আগুনকে জ্বলতে সাহায্য করে। আর ব্যোম বা অনন্ত শূন্য জেগে থাকে তার গর্ভে।
১. দ্বিমুখী প্রদীপ: ভগবানের অসীম কৃপা লাভ, আশীর্বাদ লাভ এবং দীর্ঘজীবনের অধিকারী হওয়া যায় দ্বিমুখী প্রদীপ জ্বালালে। এটাই ভক্তদের বিশ্বাস।
২. ত্রিমুখী প্রদীপ: লোকবিশ্বাস, এই প্রদীপ জ্বালালে শত্রুর কু-নজর থেকে ভগবান বিষ্ণু ভক্তদের রক্ষা করেন।
৩. চতুর্মুখী প্রদীপ: সন্তানের দীর্ঘজীবন কামনা করে মা-বাবারা এই প্রদীপ জ্বালেন।
কার্তিক মাসব্যাপী সন্ধ্যার সময় অনেক গৃহে তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালানোর রীতি রয়েছে। পুকুরে বা নদীতেও অনেক সময় প্রদীপ ভাসানো হয় ভগবানের আশীর্বাদ এবং কৃপা লাভের উদ্দেশ্যে। আকাশপ্রদীপ দেওয়ার মন্ত্রটি হলো- “আকাশে সলক্ষ্মীক বিষ্ণোস্তোষার্থং দীয়মানে প্রদীপঃ শাকব তৎ।” আকাশে লক্ষ্মীর সঙ্গে অবস্থান করছেন যে বিষ্ণু, তাঁর উদ্দেশে দেওয়া হল এই প্রদীপ। ঘটের মতো প্রদীপকেও অনেক পণ্ডিত দেহেরই প্রতীক বলে মনে করেন। আকাশ-প্রদীপও নশ্বর শরীরের মতো ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম- এই পঞ্চভূতে তৈরি।
কার্তিক ঠাকুরের প্রিয় ফুল:-
কার্তিক পুজোর সময় দেবতাকে রঙীন ফুল দিতে পারেন। লাল গোলাপ, পদ্ম, নীল, অপরাজিতা, হলুদ চাঁপা, গাঁদা ফুল তাঁর খুব পছন্দের। তবে ঠাকুরের পছন্দের ফুল রক্ত করবী। তা না পাওয়া গেলেও দিতে পারেন হলুদ বা সাদা করবী। পুজোর দিনে কার্তিক ঠাকুরকে দিতে পারেন ৫ গোটা ফল। এছাড়াও বাচ্চারা যে খেলনা নিয়ে খেলতে ভালোবাসে, সেই খেলনা দিতে পারেন। এছাড়াও দেবতাকে পায়েস ভোগ দিন।
কার্তিক পুজোর দিন তুলসী পুজো:-
কার্তিক পুজোর দিনে তুলসী পুজো করতে পারেন সকালে। এমনই মত শাস্ত্রজ্ঞদের। সন্ধ্যায় বাড়ির তুলসী মঞ্চে দিতে পারেন ঘিয়ের প্রদীপ। সন্তানের পড়াশোনার মঙ্গলের জন্য, কার্তিক ঠাকুরের পাশে রাখা ময়ূরের পালক রেখে দিন সন্তানের পড়াশোনার স্থানে। পুজোর সময় অবশ্যই একটা বাঁশি, তীর-ধনুক এবং ময়ূরের পালক ঠাকুরের কাছে রাখবেন। সেখান থেকেই ময়ূরের পালক নিয়ে কাছে রাখবেন।