বিনোদন

বিষাক্ত বিশ কেড়ে নিয়েছে যাঁদের!

জীবনের খাতায় আরও এক বছরের অধ্যায় সম্পূর্ণ। বিষাক্ত একটা বছর শেষ হচ্ছে।  জোড়া বিশের এই বছর নীলকণ্ঠের গরলের চাইতে কোনও অংশে কম ছিল না। করোনা, আমফান, জীবনে আইসোলেন, স্যানিটাইজার, মাস্কের গুরুত্ব বোঝা। মানুষের পরিযায়ী তকমা পাওয়া।  বোঝার এই বোঝা নিয়েই প্রায় গোটা বছরটা কাটল। পাওয়া না পাওয়ার হিসেব করতে বসে সকলেরই মনে হচ্ছে, প্রাপ্তিযোগ শূণ্য। হৃদয়ের ভাঁড়ার কেবল খালি হয়ে গিয়েছে, স্বজন হারিয়েছে কত জন। এই দশকের অন্যান্য বছরগুলিতে আমরা এভাবে হারাইনি প্রিয়জনদের। না পাওয়ার পথ বেয়ে অজানিতের অন্ধকারে চলে গিয়েছেন বহু গুনীজন। আজ বছর শেষে আরও একবার তাঁদের স্মরণ করার পালা।

তাপস পাল (১৯৫৮২০২০): এই নামের পাশে এক বন্ধনীতে যদি কোনও একটি কথা লেখা যায়, তাহলে তা নিঃসন্দেহে ‘দাদার কীর্তি’। বাংলা সিনেমা জগতে এই সিনেমা থেকে তাপস পালের নাম বাঙালি হৃদয়ে খচিত হয়ে গিয়েছে স্থায়ীভাবে। ‘গুরুদক্ষিণা’, ‘সাহেব’, ‘পারাবত প্রিয়া’, ‘মায়া মমতা’ – আরও কত সিনেমা যে স্রেফ তাপস পালের অভিনয়ে সিনেপ্রেমী দর্শকের মনে রয়ে গিয়েছে, ঠিক নেই। অভিনেতা ছাড়া রাজনীতিক হিসেবেও তাঁর পরিচয় ছিল। বিধায়ক, সাংসদ নির্বাচিত হয়ে একাধিক বিতর্কে জড়ান। চিটফান্ড-কাণ্ডে কারাবাসও করতে হয় রুপোলি পর্দার নায়ককে। ২০১৬ সাল থেকে শারীরিক ও মানসিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। মুম্বইয়ের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি ভেন্টিলেশনে ছিলেন। সেরেও উঠছিলেন কিন্তু কলকাতায় আসার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। দীর্ঘদিন রোগে ভুগে ২২ ফেব্রুয়ারি, ৬১ বছর বয়সে সমস্ত জনপ্রিয়তা, বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৫-২০২০):  ‘অপুর সংসার’, ‘কোনি’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ – কতশত ছবি! আদ্যন্ত শিল্পী মানুষ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শিল্পপ্রতিভার বিকাশ ঘটেছে আবৃত্তি, নাটক থেকে সাহিত্যকর্মেও। দেশ-বিদেশের স্বীকৃতি পেয়েছেন অজস্র। আবার আদর্শকে আঁকড়ে ধরে বেশ কিছু পুরস্কার প্রত্যাখ্যানও করেছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আয়ু ফুরোচ্ছিল তাঁর। ১৫ নভেম্বর, রবিবার, ছুটির দিনে আজীবনের জন্য ছুটি নিয়ে নিলেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম নক্ষত্র। তাঁর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে শেষ হলো এক যুগের ৷ তবে তাঁর সামগ্রিক জীবন এতটাই উজ্জ্বল, যা ফিকে হওয়ার নয়।

অমলাশঙ্কর (১৯১৯-২০২০): নৃত্য জগতের এক অন্যতম নক্ষত্রের নাম অমলাশঙ্কর। স্বামী উদয় শঙ্করের সৃষ্ট নৃত্যশৈলীকে বহন করে নিয়ে গিয়েছেন এক অনন্য মাত্রায়। উদয়শংকর পরিচালিত ছায়াছবি ‘কল্পনা’-তে অভিনয়ও করেছেন। এ বছর ২৭ জুন, ১০১ বছর বয়সে প্রয়াত হন প্রবাদপ্রতিম নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্কর।

সন্তু মুখোপাধ্যায় (১৯৫১২০২০): ১৯৭৫ সালে ‘রাজা’ সিনেমা দিয়ে অভিনয়ের যাত্রা শুরু। তারপর ২০২০ পর্যন্ত বেশ দাপটের সঙ্গে বড়পর্দা, ছোটপর্দায় কাজ করেছেন সন্তু মুখোপাধ্য়ায়। পড়াশোনায় তেমন মন ছিল না। দ্বাদশ শ্রেণির পরই তা ছেড়ে দিয়েছিলেন সন্তু মুখোপাধ্য়ায়। কলকাতার ছেলেটি ওই বয়সে নাচ, গান শেখার জন্য গুরুর সন্ধানে ছিলেন। তাঁকে টেনেছিল নাটকের মঞ্চও।  তবে শরীরে বাসা বেঁধেছিল ক্যানসার। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চরক্তচাপ, সুগারের সমস্য়া। এসবের সঙ্গে লড়াই করে শেষপর্যন্ত হেরে গেলেন। ১১ মার্চ, ৬৯ বছরে নিভল তাঁর জীবনদীপ। রেখে গেলেন সুযোগ্য কন্যা অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়কে।

ইরফান খান (১৯৬৭২০২০): মনে পড়ে ‘লাইফ ইন এ মেট্রো’র একটু অদ্ভুত ধরনের মানুষ মন্টিকে? কিংবা ‘দ্য লাঞ্চবক্স’-এর গম্ভীর, হাসতে ভুলে যাওয়া সাজন ফার্নান্ডেজ? এক লহমায় যে ছবিটা চোখের সামনে ফুটে ওঠে, সেই মানুষটা রিল এবং রিয়েল লাইফ থেকে আচমকাই ‘ভ্যানিশ’। অনুরাগীদের স্মৃতির খাতায় রেখে গেলেন ‘পান সিং তোমর’, ‘লাইফ অফ পাই’, ‘পিকু’, ‘হিন্দি মিডিয়াম’, ‘তলোয়ার’, ‘ডুব’-এর মতো সুপারহিট সিনেমা। শরীরে বাসা বেঁধেছিল কর্কটরোগ। এপ্রিলের ২৯ তারিখ। এটাই তাঁর জীবনের শেষ দিন। এরপর আর কখনও রুপোলি পর্দায় ভেসে উঠবে না তাঁর সেই বলিষ্ঠ চেহারা।

ঋষি কাপুর (১৯৫২২০২০): কথায় বলে, জন্মগত প্রতিভা। ঋষি কাপুরের অভিনয় প্রতিভা জন্মগত বললেও অত্যুক্তি হয় না। শিশুকালে লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশনের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল তাঁর – ‘মেরা নাম জোকার’ সিনেমার হাত ধরে। সালটা ১৯৭০। পরবর্তীতে সেটাই হয়ে উঠল প্রেম। ‘দিওয়ানা’, ‘ববি’র মতো সুপারহিট ফিল্ম থেকে সাম্প্রতিক সময়ের ‘কাপুর অ্যান্ড সন্স’, ‘১০২ নট আউট’ – প্রতিটি ছবিতে পরিণত থেকে আরও পরিণত অভিনয়ের ছাপ ফেলে গিয়েছেন তিনি। শরীরে বাসা বেঁধেছিল মারণ কর্কটরোগ। এপ্রিলের ৩০ তারিখ ৬৭ বছর বয়সে প্রয়াত হন ঋষি।

ওয়াজিদ খান (১৯৭৮২০২০): ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া’ দিয়ে পথচলা শুরু। সেটা ১৯৯৮ সাল, বয়স মাত্র ২০ বছর। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি সংগীতকার ওয়াজিদ খানকে। সলমন খানের বহু ছবিতে কাজ করেছেন ওয়াজিদ। ‘গর্ব’, ‘তেরে নাম’, ‘তুমকো না ভুল পায়েঙ্গে’, ‘পার্টনার’, ‘দাবাং’ ছবিতে নিজের জাদুতে মন ছুঁয়েছেন দর্শকদের। রিয়্যালিটি শো ‘সারেগামাপা’তে বিচারক ছিলেন সাজিদ-ওয়াজিদ। আইপিএল ৪-এর থিম সং ‘ধুম ধাড়াকা’ লিখেছিলেন তাঁরা। কিন্তু জুনের ১ তারিখ ওয়াজিদ খানের মৃত্যুতে ভেঙে গেল সাজিদ-ওয়াজিদ জুটি।

সুশান্ত সিং রাজপুত (১৯৮৬২০২০): একটি বিতর্কে ঘেরা মৃত্যু। বলিউডের উদীয়মান প্রতিভা সুশান্ত সিং রাজপুতের দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া ছিল শুধুই সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু হঠাৎ সব অপেক্ষা অর্থহীন করে দিয়ে ব্রেকিং নিউজ হয়ে গেল মাত্র ৩৪ বছরে তাঁর অকাল বিদায়! প্রেম, মাদকাসক্তি, নেপোটিজম – একটার পর একটা ঘূর্ণাবর্তে উথালপাথাল হল দেশ। সেসবের ঝাপটায় হয়ত বা কিছুটা পিছনপানে সরে গিয়েছিল তাঁর প্রথম ছবি ‘কাই পো ছে’র সেই প্রাণোচ্ছ্বল ছেলেটি কিংবা ‘এমএস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’র দাপুটে ক্রিকেটার অথবা ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সি’র মেধাবী গোয়েন্দা। খুব অল্প দিনেই এসে পড়েছিলেন প্রচারের আলোকবৃত্তে। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাত। জুন মাসের ১৪ তারিখ বান্দ্রায় নিজের ফ্ল্যাটে উদ্ধার হল বলিউডের সম্ভাবনাময়, সদাহাস্যময় নায়কের মৃতদেহ। তবে মৃত্যুরহস্যের জট খুলল না।

সরোজ খান (১৯৪৮২০২০): মাত্র তিন বছরেই ঘুঙুরের শব্দে নিজের আজীবনের প্রেম খুঁজে পেয়েছিল মেয়েটি। তারপর আর থামেনি কোথাও। মনপ্রাণ দিয়ে নাচই করে গিয়েছেন বলিউডের জনপ্রিয় কোরিওগ্রাফার সরোজ খান। বলিউডের প্রচুর সিনেমা হিট হয়েছে স্রেফ তাঁর নৃত্যশৈলীর গুণে। নায়ক-নায়িকাদের কাছে তিনি ছিলেন ‘মাস্টারজি’। ‘এক দো তিন’, ‘তাম্মা তাম্মা লোগে’, ‘ধক ধক করনে লাগা’, ‘বেটা’, ‘গুলাব গ্যাং’, ‘কলঙ্ক’ খুবই প্রশংসিত হয়। এছাড়া ছোটপর্দার রিয়্যালিটি শো’এর বিচারক হিসেবেও সরোজ খানকে দেখা গিয়েছে। কিন্তু বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে ৭১ বছর বয়সে জুলাইয়ের ৩ তারিখ প্রয়াত হন নাচের রানি।

এসপি বালাসুব্রহ্মণ্যম (১৯৪৬২০২০): সুর আর কথার মিলন ঘটাতে পারেন ক’জন? এসপি বালাসুব্রহ্মণ্যম পেরেছিলেন। বহুমুখী প্রতিভা তাঁর। নয়ের দশকের ‘পহেলা পহেলা প্যায়ার’, ‘হম বনে তুম বনে’ থেকে হালফিলের ‘চেন্নাই এক্সপ্রেসে’র টাইটেল ট্র্যাক – তিনি গেয়ে উঠলেই যেন সুরের জগত আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠত। সংগীত পরিচালনা, গান গাওয়া, অভিনয়, ছবি প্রযোজনা – সব কাজেই এসপি বালাসুব্রহ্মণ্যম রেখে গিয়েছেন স্বকীয়তার ছাপ। প্রায় ৫০ বছরের কেরিয়ারে এসপি-র গানের সংখ্যা ৪০ হাজার! অন্যান্য পুরস্কারের পাশাপাশি ‘পদ্মশ্রী’, ‘পদ্মভূষণ’এও সম্মানিত হন এসপি। তবে ৭৪ বছরের সংগীতকারকে কাবু করে ফেলেছিল মারণ ভাইরাস করোনা। ২৫ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন এসপি বালাসুব্রহ্মণ্যম।

আসিফ বাসরা (১৯৭৬২০২০): ছকে বাঁধা পথের পথিক ছিলেন না তিনি। বরাবর ভিন্ন ঘরানার অভিনয় করেছেন। আর তাতেই আসিফ বাসরা সিনেপ্রেমীদের হৃদয়ে নিজের একটি জায়গা করে নিয়েছিলেন পাকাপাকিভাবে। ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’, ‘পারজানিয়া’, ‘ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন মুম্বই’-এর মতো ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে তাঁর অভিনয় ভুলতে পারবেন না ফিল্ম সমালোচকরা। কিন্তু জীবন তো সিনেমার মতো চিত্রনাট্য নির্ভর হয় না। ১২ নভেম্বর, ধর্মশালার এক অ্যাপার্টমেন্ট থেকে উদ্ধার হয় আসিফের ঝুলন্ত দেহ। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে এক প্রতিশ্রুতিমান অভিনেতাকে হারাল বলিউড।

চ্যাডউইক বোসম্য়ান (১৯৭৬২০২০): রিল লাইফের ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ হারিয়ে দিয়েছিল অনেককে। এছাড়া মার্শাল, ডিএ ৫ ব্লাডস, ব্ল্যাক বটম থেকে শুরু করে মার্ভেল সিরিজের একের পর এক সিনেমায় দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দিয়েছেন চ্যাডউইক বোসম্যান। রুপোলি পর্দায় একের পর এক যুদ্ধ জয়ের শরীরে বাসা বেঁধেছিল কোলন ক্যানসার। আর তার থাবায় জীবনযুদ্ধে মাত্র ৪৩ বছর বয়সেই হেরে গেলেন নায়ক।