নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রের পুনর্গণনার আর্জি নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেননা তৃণমূলের তরফে এবার নন্দীগ্রামে প্রার্থী হয়েছিলেন স্বয়ং মমতাই। সেই নির্বাচনী ফলাফলের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে বেশ কিছু বিতর্কও। তার জেরেই মুখ্যমন্ত্রী দ্বারস্থ হয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের। এর আগে গত শুক্রবার মামলাটি শুনানির জন্য উঠেছিল বিচারপতি কৌশিক চন্দের এজলাসে। কিন্তু সেদিন যেমন আবেদনকারী হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন না তেমনি হাইকোর্টের বার কাউন্সিলের সদস্যদের একাংশ সেদিন বিক্ষোভও দেখিয়েছিলেন বিচারপতি চন্দে এজলাসে মামলাটি শুনানির জন্য ওঠায়। কেননা সেদিনই সোশ্যাল মিডিয়ার মারফর সামনে এসেছিল বিচারপতি চন্দ ও বিজেপির সম্পর্কের বিষয়টি। ফলে মামলার বিচার নিরপেক্ষ হবে কিনা তা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যায়।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা নাগাদ কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি কৌশিক চন্দের বেঞ্চে নন্দীগ্রাম বিধানসভার ফল সংক্রান্ত মামলার শুনানি শুরু হয়। গত শুক্রবার বিচারপতি কৌশিক চন্দ জানিয়েছিলেন নির্বাচনী মামলায় আবেদনকারীকে উপস্থিত থাকতে হবে। সে জন্যই এদিন শুনানিতে ভার্চুয়ালি উপস্থিত থাকেন মুখ্যমন্ত্রী। এদিন মামলা দ্বিতীয়বারের জন্য বিচারপতির চন্দের এজলাসে ওঠার পর কার্যত সেই একই দাবির মধ্যে দিয়ে এদিনের শুনানি শেষ হয়। মুখ্যমন্ত্রীর আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি এদিন শুনানির শেষভাগে সরাসরি বিচারপতি চন্দকে আবেদন করে জানান, ‘আপনাকে অনুরোধ করব মামলা থেকে সরে যান।’ শুনানির শুরুতে বিচারপতি কৌশিক চন্দ মুখ্যমন্ত্রীর আইনজীবী সিঙ্ঘভিকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনারা প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করেছিলেন পুনর্বহালের জন্য? এটা কোন ধরনের পদ্ধতি? আপনারা তো এখানে এসে আপনাদের কথা জানতে পারতেন। এটা কোন ধরনের শিষ্টাচার? ১৮ জুনের আগে মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। তখন কেন এই মামলার নিরপেক্ষতা নিয়ে বলা হয়নি? আপনারা এবার বলুন, আমি কী করব? এই মামলার দু’টি দিক রয়েছে। একটি প্রশাসনিক, অপরটি বিচার সংক্রান্ত। আপনারা ঠিক করুন কোনটা বেছে নেবেন।’ পরে বিচারপতি জানান, জনপ্রতিনিধি আইনের ৮১ নম্বর ধারা অনুযায়ী শুনানি শুরু হবে। এরপরেই পুনর্বহালের আবেদন নিয়ে বিচারপতির প্রশ্নের জবাব দেন সিঙ্ঘভি। তিনি বলেন, ‘আপনি শুনতে চান বা না চান, আমি বুঝতে পারছি না কেন নিয়ম মেনে বেঞ্চ বদল হবে না। এতে সমস্যা কোথায়? পুনর্বিবেচনা নিয়ে প্রথমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে ঘোড়ার আগে গাড়ি দৌড়ের মতো হবে। আমরা জানতাম মামলাটি বিচারপতি সব্যসাচী ভট্টাচার্যের বেঞ্চে যাবে। হঠাত্ ১৬ জুন জানতে পারি আপনার বেঞ্চে এসেছে মামলাটি। এখানে পক্ষপাতিত্ব নিয়ে অভিযোগ করা যেতে পারে। আপনার সঙ্গে বিজেপির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আপনি বিজেপির লিগ্যাল সেলের প্রধান ছিলেন। বিজেপির হয়ে বিভিন্ন মামলায় আপনাকে উপস্থিত থাকতে দেখা গিয়েছে। আপনার সঙ্গে বিজেপির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত, পেশাগত, এবং আদর্শগত সম্পর্ক রয়েছে। এরপরই অভিষেক মনু সিংভি জানান, বিচারপতি বিজেপির লিগাল সেলের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন ৷ আর ঠিক সেখানেই তৃণমূল সুপ্রিমোর আপত্তি ৷ এই প্রসঙ্গেই বিচারপতি পাল্টা জানান , মামলার সংশ্লিষ্ট দুই আইনজীবী অর্থাৎ অভিষেক মনু সিংভি ও সৌরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ও তো যথাক্রমে কংগ্রেস ও বিজেপি ঘনিষ্ঠ ৷ আমার আগের বিভিন্ন সময়ের পর্যবেক্ষণ বলছে এই ধরনের মামলায় নিরপেক্ষ বিচার নিয়ে আশঙ্কা থেকে যায়। পক্ষপাতিত্বহীন বিচার আদালতের দায়িত্ব। এবং তা আদালতের নিশ্চিত করা উচিত।’ একই সঙ্গে এদিন সিঙ্ঘভি নন্দীগ্রাম মামলার আবেদন সময়মতো করা হয়েছে বলেও দাবি করেছেন। এই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই ধরনের মামলা করার জন্য ৪৫ দিন সময় থাকে। সময়মতো তা করা হয়েছিল। কিন্তু কোনও বেঞ্চ খালি পাওয়া যায়নি। তাই এত দিন শুনানি শুরু হয়নি। ২১ মে এই আবেদন করা হয়েছিল।’ এরপরে বিচারপতি পাল্টা সিঙ্ঘভিকে বলেন, ‘আপনাদের অসুবিধা হচ্ছে আমি বিজেপির লিগ্যাল সেলের হেড ছিলাম বলে তাই তো? বুঝতে পেরেছি। মিঃ সিঙ্ঘভি আপনি কি বিজেপির সাংগঠনিক কাঠামো সম্বন্ধে জানেন?’ বিচারপতির এই প্রশ্নের জবাবে সিঙ্ঘভি বলেন, ‘আমার অনেক বন্ধু বিজেপিতে রয়েছে, আমি ভালো করেই জানি। অধিভোক্তা পরিষদে আমাকে বক্তব্য রাখার জন্য ডাকা হয়েছিল। কিন্তু আমি যায়নি।’ তখন বিচারপতি তাঁকে বলেন, ‘বিজেপির মোর্চা ও সেল রয়েছে। দু’টির কাঠামো আলদা। আমি যখন বিজেপির হয়ে মামলা লড়েছিলাম, তখন বিচারপতি আমাকে বলেছিলেন, কোন দলের? আমি বলেছিলাম, ভারতীয় জনতা পার্টির। তিনি বুঝতে পারেননি। আমি যখন বললাম বিজেপি। তখন তিনি বুঝতে পারলেন। আবেদনকারীর পূর্ন অধিকার রয়েছে পুনর্বিবেচনার আর্জি জানাতে। আইনি ভাবে তা দেখা হবে।’ এরপরেই সিঙ্ঘভি বিচারপতিকে এই মামলা থেকে সরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন ও তাঁকে তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন এবং প্রশান্ত ভূষণের টুইটের কথা উল্লেখ করেন। এ রকম টুইট কমপক্ষে ১০০টি আছে বলেও জানান তিনি। এর পর বিচারপতি বলেন, ‘হ্যাঁ লক্ষ্য করেছি। বিজেপি সদস্যদের সঙ্গে আমরা ছবি টুইট করা হয়েছে। আপনাদেরও রাজনৈতিক যোগ রয়েছে। আপনি কংগ্রেসের। তার পরও মুখ্যমন্ত্রীর হয়ে মামলা লড়ছেন। বিচারকের ভূমিকা পবিত্র। আইনজীবীর থেকে আলাদা। ১৮ জুন শুনানির সময়ে আপনারা এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ করলেন না। আমি বাড়ি ফেরার পর জানতে পারলাম আমার বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমে বিচার হয়ে গিয়েছে। আচ্ছা। ঠিক আছে। আপনাদের দাবি বিবেচনা করছি। আপাতত এই নির্দেশ মুলতুবি থাকল।’ এই সওয়াল-জবাবের পরই বিচারপতি আজকের মতো মামলার রায়দান মুলতুবি থাকল বলে জানান ৷ আগামা শুনানি কবে , সেবিষয়ে এখনও পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি ৷