কাল ভৈরবকে ভগবান শিবের উগ্র রূপ বলা হয়। হিন্দু ধর্মে কাল ভৈরব জয়ন্তীর আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে।কথিত আছে যে মার্গশীর্ষ মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে ভগবান কাল ভৈরব অবতারণা করেছিলেন। এ বছর কাল ভৈরব জয়ন্তী শুরু হবে শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, সন্ধ্যা ৬ টা ৭ মিনিট থেকে থেকে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে এই দিনে পূর্ণ আচারের সঙ্গে পুজো করলে একজন ব্যক্তি সমস্ত ব্যথা, নেতিবাচকতা এবং ভয় থেকে মুক্তি পায়। কাল ভৈরব জন্মতিথিতে, অভিজিৎ মুহূর্ত হবে ২৩ নভেম্বর সকাল ১১ টা ৫০ মিনিট থেকে ১২ টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত। বিশ্বাস করা হয় যে শুভ সময়ে পুজো করলে ব্যক্তির বাড়িতে সুখ, শান্তি এবং সমৃদ্ধি আসে। কাল ভৈরব জয়ন্তীর দিন পুজো করতে হলে ভোরে স্নান করতে হবে। অতঃপর পরিষ্কার পোশাক পরিধান করে ব্রত রাখার অঙ্গীকার গ্রহণ করুন। এর পরে ভগবান শিবের পুজো করুন এবং তারপর ভগবান কাল ভৈরবের পুজো শুরু করুন। এর পর ভগবান কাল ভৈরবকে কালো তিল, মাস কলাইয়ের ডাল এবং সরিষার তেল নিবেদন করুন। এরপর সরিষার তেলের প্রদীপও জ্বালান। শেষে ভগবান কাল ভৈরবের আরতি করুন। পুজো শেষ করে কালো কুকুরকে মিষ্টি রুটি খাওয়ান। এতে করে কাল ভৈরবকে প্রসন্ন হন। ভৈরব তুষ্ট হলে ভক্তদের মনষ্কামনা পূরণ করেন বলে মনে করা হয়। এই দিনে শিবের পাশাপাশি মা পার্বতী ও গণেশেরও পুজো করা উচিত।
কাল ভৈরব জয়ন্তীর তাৎপর্য:
বিশ্বাস করা হয় যে ভগবান কাল ভৈরব যাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হন, তিনি কখনই নেতিবাচক শক্তি, বাধা, ঝামেলা, গুপ্ত শত্রুতার মুখো মুখি হন না, এমনকি রাহু-কেতু- শনির প্রভাবও নাশ হয়। তাছাড়া নেগেটিভ শক্তি বা ভূত-প্রেতকে বিতারিত করে। এছাড়াও, জীবনের সমস্ত অসুবিধা দূর হয়ে যায় এবং সমাজে আপনার সম্মান বাড়তে থাকে। রাতে মন্ত্র উচ্চারণ করলে গ্রহের অশুভ প্রভাব দূর হয় এবং ভৈরব বাবার কৃপায় সমস্ত ইচ্ছা পূরণ হয়। কাল ভৈরবকে কাশীর কোতওয়াল বলা হয়। তাঁর আরাধনা ব্যতীত কাশী বিশ্বনাথের পুজো করা অসম্পূর্ণ। কাল ভৈরবের পুজো ও দান করলে মানুষের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পায়। কালাষ্টমীর দিন দান করলে মানুষ অনেক উপকার পায়। এই দিনে দান করলে মানুষের সমস্ত পাপ নাশ হয় এবং সে মোক্ষ লাভ করে।কাল ভৈরবের কালো তিল খুবই প্রিয়। কালো তিল দান করলে মানুষের সমস্ত পাপ নাশ হয় এবং সে মোক্ষ লাভ করে। কালো ছোলা দান করলে একজন ব্যক্তি আর্থিকভাবে লাভবান হন এবং জীবনে সাফল্য লাভ করেন। এই দিনে উপবাস করে ভগবান কাল ভৈরবের পুজো করা হয়। ভগবান শিবের উগ্র অবতার বলে মনে করা হয় কাল ভৈরবকে। কাল ভৈরবের বাহন কালো কুকুর। বিশ্বাস করা হয় যে শিব ও পার্বতীর মন্দির দেখাশোনা করেন কাল ভৈরব। পঞ্জিকা অনুসারে, প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে পালন করা হয় কাল ভৈরব জয়ন্তী। ২০২৪ সালে, কাল ভৈরব জয়ন্তী পালন করা হবে ২৩ নভেম্বর ২০২৪। শিবপুরাণ থেকে স্কন্দপুরাণ পর্যন্ত কাল ভৈরবের উৎপত্তির কাহিনী বর্ণিত রয়েছে।
পুরাণ অনুসারে
হিন্দু পুরাণ অনুসারে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা এবং রক্ষাকর্তা ভগবান বিষ্ণুর মধ্যে তাদের আধিপত্য নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছিল। তাদের বিরোধ চলাকালীন, তাদের সামনে একটি বিশাল প্রকাশ (অগ্নি) স্তম্ভ আবির্ভূত হয়, যা তাদের উভয় শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে। তারা প্রকাশ (অগ্নি) স্তম্ভের শুরু এবং শেষ খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু কেউই সফল হতে পারেনি। এরপরই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা মিথ্যের আশ্রায় নেয় এবং নিজেকে ‘পরম ব্রহ্ম’ বলে দাবি করেন। তখনই দেবাদিদেব শিবের ক্রোধ দেখা যায়। তারপর ভগবান শিব প্রকাশ (অগ্নি) স্তম্ভের মধ্যে থেকে কাল ভৈরব নামে পরিচিত এক ভয়ানক এবং অনুপ্রেরণাদায়ক সত্তার রূপে আবির্ভূত হন। স্তম্ভটি ভগবান শিবের প্রকাশ ছাড়া আর কেউ ছিল না, যিনি অন্য সমস্ত দেবতার উপর তাঁর আধিপত্য প্রমাণ করার জন্য তাঁর রূপ প্রকাশ করেছিলেন। এই ঘটনাটি পরম ব্রহ্ম দেবতা হিসাবে ভগবান শিবের অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল এবং কাল ভৈরব হিসাবে প্রকাশ তাঁর শক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে। মহাদেবের রুদ্র অবতার কালভৈরবকে দেখে সমস্ত দেবতা ভয় পেয়ে যান এবং শিবকে শান্ত থাকার অনুরোধ করতে থাকেন। মহাদেব এতটাই ক্রুদ্ধ ছিলেন যে ব্রহ্মার পাঁচটি মুখের মধ্যে একটি কেটে ফেলেন কালভৈরব। এরপর ভগবান শিবের উগ্র অবতার কাল ভৈরবের কাছে ভগবান ব্রহ্মা ক্ষমা চাইলে তিনি শান্ত হয়ে যান। কিন্তু ব্রহ্মাকে হত্যার পাপের অভিযোগে শাস্তি ভোগ করতে হয় কাল ভৈরবকে। তখন ভগবান শিব তাকে তীর্থযাত্রায় যাওয়ার পরামর্শ দেন এবং পৃথিবীতে তীর্থযাত্রা করেন কাল ভৈরব। বছরের পর বছর ভিক্ষুক হয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করতে থাকেন তিনি। অবশেষে, শিবের শহর কাশীতে পৌঁছানোর পর, তিনি তার শেষ ২৪ ঘন্টা অতিবাহিত করেন। শাস্তি ভোগ করার কারণে কালভৈরবকে দন্ডপানিও বলা হয়।
কাল ভৈরব জয়ন্তীর নির্ঘন্টঃ
২০২৪ সালের কাল ভৈরব জয়ন্তী পড়ছে ২২ নভেম্বর। অর্থাৎ শুক্রবার পড়ছে কালভৈরব জয়ন্তী। ২২ নভেম্বর, সন্ধ্যা ৬ টা ০৭ মিনিট থেকে এই কাল ভৈরব জয়ন্তী পড়বে। অষ্টমী তিথি ২৩ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭ টা ৫৬ মিনিট পর্যন্ত চলবে। ভৈরব জয়ন্তীতে মধ্যরাত ১২টার পর থেকে ব্রাহ্মমুহূর্ত পর্যন্ত মন্ত্র জপ করা খুবই উপকারী বলে মনে করা হয়। কাল ভৈরবের পুজো করার পর শিবপুজো করা আবশ্যক। সঙ্গে পার্বতী গণেশ ও কার্তিকের পুজোও করা উচিত।
কাল ভৈরবের মন্ত্রঃ
১) ওম শ্রী কালভৈরবায় নমঃ, ২) ওম শ্রী বম বটুক ভৈরাবায় নমঃ এবং অপর মন্ত্র টি হল – ওম হ্রীম বটুকে আপদুদ্ধারণয় কুরু কুরু বটুকে হ্রীম।(জপ ১০৮ বার) কাল ভৈরবের এই মন্ত্রগুলো ভগবান শিবের রুদ্র রূপ, ঝামেলা এবং নেতিবাচক শক্তি থেকে রক্ষা করে। এছাড়া রাহু-কেতু-শনির প্রভাব নাশ করে। গুপ্ত শত্রুতা থেকে মিলবে মুক্তি। এছাড়া নেগেটিভ শক্তি বা ভূত-প্রেত, তান্ত্রিক কার্যকলাপ ও জাদুবিদ্যার প্রভাবও দূর হয়। অকাল মৃত্যু, পিতৃ দোষ এবং অন্যান্য বাস্তু দোষ দূর হয়। দান করার সময়, মনে মনে প্রার্থনা করুন, এতে ভগবান কালভৈরব আপনার জীবনের সমস্ত দুঃখ দূর করবেন।
আসুন জেনে নিই ভৈরব জয়ন্তীতে করা এই ব্যবস্থাগুলো সম্পর্কে –
১) কাল ভৈরব জয়ন্তীতে, ভৈরব বাবার মন্দিরে গিয়ে পুজো করুন এবং প্রসাদ হিসাবে মদের নিবেদন করুন। এর পরে সেই বোতলটি মন্দিরের কর্মচারীকে দিন। এতে করে জীবনের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং ভৈরব বাবার আশীর্বাদও পাওয়া যায়।
২) ভৈরব জয়ন্তীতে, আপনার তর্জনী (বুড়ো আঙুল) এবং মধ্যমা আঙুল (মাঝের আঙুল) তেলে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখুন এবং তারপর একটি রুটির উপর একটি রেখা আঁকুন। এর পরে, সেই রুটিটি কালো রঙের একটি কুকুরকে দিন। কুকুর যদি সেই রুটি খায়, তার মানে কাল ভৈরব বাবা আপনার উপর খুশি। এও কথিত আছে পুজো শেষ করে কালো কুকুরকে মিষ্টি-রুটি খাওয়ান। বিশ্বাস করা হয় যে এটি করলে ব্যক্তির পুজো সফল হয় এবং তিনি কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করেন।
৩) কাল ভৈরব জয়ন্তীতে সরিষার তেলে ভালো পরিমাণে পাপড়, পকোড়া ইত্যাদি ভাজুন। এরপর গরিব-দুঃখী মানুষের মধ্যে বিতরণ করুন। এতে ভৈরববাবা প্রসন্ন হন এবং সকল প্রকার ভয় থেকে মুক্তি লাভ করেন। এর পাশাপাশি আয় রোজগারের উপায়ও বাড়বে।
৪) ভৈরব জয়ন্তীর রাতে সরিষার তেলে মাস কলাইয়ের ডাল পকোড়া বানিয়ে বিনা দ্বিধায় ঘর থেকে বের হয়ে যান। এর পরে, আপনার পথে আসা প্রথম কুকুরটিকে সেই পকোড়াগুলি খাওয়ান।
৫) ভৈরব জয়ন্তীতে মধ্যরাত ১২টার পর মন্ত্র জপ করা খুবই উপকারী বলে মনে করা হয়। এই মন্ত্রগুলি জপ করলে তান্ত্রিক কার্যকলাপ ও জাদুবিদ্যার প্রভাব দূর হয়। এছাড়াও, জীবনের সমস্ত অসুবিধা দূর হয়ে যায় এবং সমাজে আপনার সম্মান বাড়তে থাকে। রাতে মন্ত্র উচ্চারণ করলে গ্রহের অশুভ প্রভাব দূর হয় এবং ভৈরব বাবার কৃপায় সমস্ত ইচ্ছা পূরণ হয়।