পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে অবসান হল ৮০০ বছরের প্রাচীন ‘দেবদাসী প্রথার’। প্রয়াত প্রভু জগন্নাথ দেবের মানব স্ত্রী তথা শেষ দেবদাসী বা মহরী পরশমণি দেবী। বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। বেশ অনেকদিন ধরেই তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। গত শনিবার ঘুমের মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন পরশমণি। তাঁর মৃত্যুতে মন্দির কর্তৃপক্ষ ও পুরোহিত বা পাণ্ডাদের পক্ষ থেকে শোকপ্রকাশ করা হয়। দ্বাদশ শতাব্দীর এই তীর্থস্থানে দেবদাসী প্রথা শেষ হয় এক যুগ আগেই। তবে জীবিত ছিলেন প্রভুর শেষ দেবদাসী পরশমণি। মন্দির শহরের বালিশাহি এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। গতকাল সোমবার পুরীর স্বর্গদ্বার মহাশ্মশানে মন্দিরের পাকশালা থেকে পবিত্র আগুন নিয়ে গিয়ে পরশমণির শেষকৃত্য সম্পন্ন করলেন তাঁর আত্মীয় প্রসন্ন কুমার দাস। গত আট দশক ধরে পরশমণি প্রভু জগন্নাথদেবের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু ২০১০ সালের পর বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি এই সেবা আর চালিয়ে যেতে পারেননি। তবে শেষদিন পর্যন্ত মন্দির কর্তৃপক্ষ ও ওড়িশা সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা করে পারিশ্রমিক বাবদ তিনি পেতেন। পাশাপাশি ওড়িশার স্বাস্থ্য দপ্তর তাঁর চিকিৎসার জন্য ২৫ হাজার টাকাও দিয়েছিল। নবকলেবর অনুষ্ঠানে দেবদাসীদের একটি বিশেষ ভূমিকা থাকত। ১৯৭৭ ও ১৯৯৬ সালে পরশমণি নবকলেবর অনুষ্ঠানে সেই ভূমিকা পালন করেছিলেন। আসলে, নবকলেবর রীতির সময় দেবদাসীদের বিধবাদের আচার পালন করতে হত। নবকলবরের পর নতুন মূর্তিতে প্রাণ সঞ্চারের পর তাঁরা ফের সিঙ্গার করতে পারতেন। ওই দুই বছর এই আচার পালন করেছিলেন পরশমণি। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, দেবদাসীরা সারাজীবন অবিবাহিত থাকতেন এবং শ্রী জগন্নাথ দেবকেই তাদের ‘স্বামী’ হিসাবে গ্রহণ করতেন। ১৯৫৫ সালে, একটি আইনের মাধ্যমে ওড়িশা সরকার রাজপরিবারের কাছ থেকে মন্দিরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল। আর তারপরই ধীরে ধীরে মন্দিরে দেবদাসী প্রথার বিলুপ্তি হয়। আরও জানা যায়, এই জগন্নাথ মন্দিরে দুই ধরণের দেবদাসী থাকতেন, একদল নৃত্যশিল্পী ও অন্যদল গায়িকা। অর্থাৎ এঁরা মন্দিরে নাচ-গানের মাধ্যমে প্রভুর সেবা করতেন৷ পরশমণি ছিলেন গায়িকা দেবদাসী। প্রভু ঘুমন্ত অবস্থায় তিনি ভক্তিমূলক গান বা গীত গোবিন্দ গেয়ে শোনাতেন। পরশমণিকে কুণ্ডনমণি দেবদাসী দত্তক নিয়েছিলেন। মাত্র সাত বছর বয়সে পরশমণির দেবদাসী প্রশিক্ষণ শুরু হয়। তারপর থেকে ঈশ্বরের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি৷ দেবদাসী বা মহরী প্রথা অনুযায়ী, মহরীরা এক কিশোরী মেয়েকে দত্তক নিতে পারতেন এবং তাঁদের গান, নাচ ও একাধিক সঙ্গীত চর্চায় পারদর্শী করে তুলতেন। যাতে তাঁদের মন্দির কর্তৃপক্ষের সামনে পেশ করা যেতে পারে এবং তাঁদেরকে ভগবানের কাজে নিয়োগ করা হয়। দেবদাসীর আর একটি নাম হল মহরী। এটা বলা হয় যে মন্দিরের অধিকারের সরকারি রেকর্ডে ‘মহরী সেবা’র উল্লেখ রয়েছে। তবে গত দু’দশকে মন্দিরে নাচ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মন্দিরের তথ্য অনুসারে, প্রায় ১০০বছর আগে, মন্দিরে ২৫জন দেবদাসী ছিলেন৷ একই সময়ে, ১৯৮০ পর্যন্ত মন্দিরে মাত্র চারজন দেবদাসী হরপ্রিয়া, কোকিলাপ্রভ, পরশমণি এবং শশমণি জীবিত ছিলেন। এই তিনজনের মৃত্যুর পরে এতদিন কেবল পরশমণিই জীবিত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হল ঈশ্বর বন্দনার এই বিশেষ প্রথার।2021-07-13 12:24:10