বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কেন ‘বিক্রম’ এবং ‘প্রজ্ঞান’? চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার আর রোভারের নামকরণের নেপথ্যকাহিনী

রোভার প্রজ্ঞানকে নিয়ে চাঁদের মাটি ছুঁয়ে ফেলল চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার বিক্রম। চন্দ্রলোকে ভারতের তৃতীয় অভিযানের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দুই ‘হাতিয়ার’। এই দুই হাতিয়ারের সাহায্যেই চাঁদের দক্ষিণ মেরুর অজানা তথ্য চলে আসবে ইসরোর হাতে। কিন্তু কেন ‘বিক্রম’ এবং ‘প্রজ্ঞান’? কেন এই দু’টি নাম বেছে নেওয়া হয়েছিল চন্দ্রযানের ল্যান্ডার এবং রোভারের? ভারতীয় মহাকাশ যাত্রার পথপ্রদর্শক তথা বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাইয়ের নামানুসারে ‘বিক্রম’ ল্যান্ডারটির নামকরণ করা হয়েছে। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার এই স্বর্ণাভ মুহূর্তের নেপথ্যেও রয়েছে বিক্রম সারাভাইয়ের অবদান। ১৯৬২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি INCOSPAR (Indian National Committee for Space Research) গঠনের মাধ্যমেই ভারতের মহাকাশ গবেষণা শুরু হয়েছিল। ভারতের মহান বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাই-এর দূরদর্শিতা এবং জওহরলাল নেহেরুর অত্যন্ত উৎসাহী সমর্থনের জন্যই আজ এটা সম্ভব হয়েছিল। বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাই ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ। জাতীয় স্তরে গঠনমূলক বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯১৯ সালের ১২ অগস্ট তাঁর জন্ম গুজরাতের বিখ্যাত সারাভাই পরিবারে। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ী পরিবারের অবদান অনেক। যদিও বিজ্ঞান থেকে ক্রীড়া হয়ে সংখ্যাতত্ত্ব, বিক্রমের আকর্ষণ ছিল বহুমুখী। তবে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তনীর আকর্ষণের ভরকেন্দ্র ছিল অবশ্যই বিজ্ঞান। তিনি আজীবন চেয়ে এসেছিলেন পারমাণবিক শক্তি ব্যবহৃত হোক মানবকল্যাণে। ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানের আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত ‘ফিজ়িক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি’ ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিক্রম। এই সংস্থাই ইসরোর পূর্বসূরি। পাশাপাশি আরও বহু সংস্থার জন্মলগ্ন থেকে জড়িয়ে আছে বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাইয়ের নাম। নেহরু ফাউন্ডেশন ফর ডেভলপমেন্ট, আইআইএম (আমদাবাদ), ভ্যারিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রোন প্রজেক্ট, ইলেকট্রনিক কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড-সহ আরও বহু সংস্থার প্রাণপুরুষ ছিলেন সারাভাই। ১৯৭৫ সালে রুশ কসমোড্রোম থেকে সফল উৎক্ষেপণ হয় ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘আর্যভট্ট’-র। এই সাফল্যে যাঁর অবদান অগ্রগণ্য, সেই বিক্রম সারাভাই কিন্তু এই সুদিন দেখে যেতে পারেননি। ১৯৭১ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে মৃত্যু হয় এই বিজ্ঞানসাধকের। বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকেরই অভিমত, তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। অন্য দিকে, রোভারটির নামকরণ হয়েছে সংস্কৃত শব্দ ‘প্রজ্ঞান’ থেকে। সংস্কৃতে যার অর্থ ‘প্রজ্ঞা’ বা জ্ঞান। ল্যান্ডার বিক্রমের মোট ওজন ১৭৪৯.৮৬। যার পেটের মধ্যে ছিল রোভার প্রজ্ঞান। প্রজ্ঞানের ওজন ২৬ কেজি। বাক্সের আকৃতির ল্যান্ডারে চারটি ল্যান্ডিং পা এবং চারটি ল্যান্ডিং থ্রাস্টার রয়েছে। রয়েছে চারটি পেলোড। চাঁদে অবতরণের পর পরই কাজ শুরু করবে ল্যান্ডার বিক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকা এই চারটি পেলোড। এই পেলোডগুলির সাহায্যেই চাঁদে বাজিমাত করবে চন্দ্রযান। এই পেলোডগুলিই চাঁদের ‘অজানা রহস্য’ খুলে দেবে ইসরোর বিজ্ঞানীদের সামনে। অন্য দিকে, একাধিক বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি নিয়ে চাঁদে নামছে রোভার। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চাঁদের ভূমিরূপ কী ভাবে তৈরি হয়েছে, কোন কোন উপাদান দিয়ে চাঁদের মাটি তৈরি, তা খতিয়ে দেখে বার্তা পাঠাবে প্রজ্ঞান। আগামী দু’সপ্তাহ ধরে স্পেকট্রোমিটার বিশ্লেষণের মাধ্যমে চাঁদের মাটিতে কোন ধরনের খনিজ বস্তু আছে, তা খুঁটিয়ে দেখবে সে। এই সমস্ত পরীক্ষাগুলি করার জন্য ল্যান্ডার এবং রোভারের সঙ্গে রয়েছে পাঁচটি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি।