২৫ শে ডিসেম্বর যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন। এই বড়দিন একটি পবিত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এই দিনটিতে খ্রিস্টানরা যীশুখ্রিষ্টের জন্মবার্ষিকী উদযাপন পালন করে। যদিও বাইবেলে যীশুর জন্মের কোন দিন ক্ষণ পাওয়া যায়নি। খ্রিস্টানদের বিশ্বাস মতে ২৫ শে ডিসেম্বর যীশুর জন্ম তারিখ ধরা হয়। উপহার একচেঞ্জ করা, ক্রিসমাস ট্রি সাজানো, মিষ্টি বিতরণ করা আর অব্যশই সান্তা ক্লজের অপেক্ষা করা।
কেন এই ক্রিস্টমাস ?
ইতিহাস বলছে, ২৫ ডিসেম্বর বেথেলহেম নগরের এক গো-শালায় কুমারী মা মেরির কোলে জন্মেছিলেন মানব ত্রাতা Jesus Christ। ঈশ্বর পুত্রের আবির্ভাব মানুষের মনে ঈশ্বরপ্রীতি, পারস্পরিক সৌভ্রাতৃত্ব, ভালোবাসা জাগাতে। বিশ্ব থেকে হিংসা মুছতে। আর তার জন্য তিনি ক্রুশ বিদ্ধ হয়ে প্রাণ দিতেও দ্বিধা করেননি। তাঁর অনুগামীরা সমাজে খ্রিস্টান হিসেবে পরে পরিচিত হন। ধর্ম ভাগ হয়ে যায় ক্যাথলিক আর প্রোসেস্টান্টে। যীশুর বাণী সম্বলিত গ্রন্থ পরে বাইবেল নামে পরিচিত হয় বিশ্বে।
২৫ ডিসেম্বর বড়দিন কেন ?
বাইবেলে যীশুর কোনও জন্মতারিখ দেওয়া নেই। তবে ৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ যীশুর জন্মের আগে রোমে প্রথম খ্রিস্টান সম্রাটের আমলে ২৫ ডিসেম্বর প্রথম বড়দিন উদযাপিত হয়েছিল। কয়েক বছর পরে, পোপ জুলিয়াস আনুষ্ঠানিকভাবে অই তারিখকে যীশুর জন্মদিন হিসেবে ঘোষণা করেন।
ক্রিস্টমাস ট্রি কেন ?
উৎসবে এই গাছ সাজানোর রেওয়াজ কম করে হাজার বছর আগে। উত্তর ইউরোপে তখন ফার গাছকে এভাবে সাজানো হত। ফার গাছ ছাড়াও আলো দিয়ে সাজানো হত চেরি গাছকেও। যাঁরা খুব গরিব, তাঁরা কাঠের টুকরো জড়ো করে ত্রিভুজ আকার দিয়ে তাকে সাজাতেন। আস্তে আস্তে এই চল ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। আলো, মিষ্টি, খেলনা, তারা, ঘণ্টা দিয়ে সাজানো হতে থাক তাকে। ধীরে ধীরে উৎসবের এই ঢেউ এসে লাগে ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বেও। একই ভাবে ২৫ ডিসেম্বরে ক্রিস্টমাস ট্রি সাজানো হয় এখানেও। এছাড়াও, বাস্তুমতে ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর পেছনেও রয়েছে বহু কারণ। দেখে নিন কারণগুলি- ১) বাস্তুমতে মনে করা হয় ক্রিসমাস ট্রি অশুভ শক্তি থেকে নিজেকে ও বাড়িকে রক্ষা করে। ২) ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয় অনেকটা ছন্দোবদ্ধ ভাবে। ফলে মনে করা হয় এই ছন্দোবদ্ধ বস্তু বাড়িতে থাকলে জীবনও ছন্দোময় ও সুন্দর হয়ে ওঠে। ৩) সান্তা ক্লজের মূর্তি ক্রিসমাসের এক অনন্য প্রতীক। আর, এই ক্রিসমাস ট্রির গায়ে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে ছোট্ট সান্তা ক্লজের মূর্তি, যা নিষ্পাপ শিশুর প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ৪) ক্রিসমাস ট্রিতে থাকা তারা যীশুখ্রীস্টের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমরা এটি আমাদের জীবনীশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। বিশ্বাস করা হয় যে, কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও এই শক্তি সঠিক পথের সন্ধান দেয়। ৫) মনে করা হয়, ক্রিসমাস ট্রি রং-বেরংয়ের জিনিস দিয়ে সাজানোর ফলে এটি আমাদের জীবনেও বৈচিত্র্য আনে। ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে সাহায্য করে।
স্যান্টা ক্লজ কি ?
পাশ্চাত্য সংস্কৃতির একটি কিংবদন্তি চরিত্র। তিনি সেইন্ট নিকোলাস, ফাদার খ্রিষ্টমাস, ক্রিস ক্রিঙ্গল বা সাধারণভাবে “সান্টা” নামে পরিচিত। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, তিনি খ্রিষ্টমাস ইভ বা ২৪ ডিসেম্বর তারিখের সন্ধ্যায় এবং মধ্যরাতে অথবা ফিস্ট ডে বা ৬ ডিসেম্বর তারিখে (সেন্ট নিকোলাস ডে) ভাল ছেলেমেয়েদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে তাদের উপহার দিয়ে যান। এই কিংবদন্তির উৎস ঐতিহাসিক চরিত্র উপহার-প্রদানকারী সেন্ট নিকোলাসের জীবন সংক্রান্ত সন্তজৈবনিক উপাদানসমূহ। গ্রিক ও বাইজানটাইন লোককথাতেও বাসিল অফ সিসেরিয়া সংক্রান্ত একই প্রকারের একটি কিংবদন্তির উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে। বাসিলের ফিস্ট ডে বা ভোজদিবস পয়লা জানুয়ারি গ্রিসে উপহার আদানপ্রদানের দিন। সেন্ট নিকোলাসের প্রকৃত চিত্রটি ছিল এক বিশপের আলখাল্লা পরিচিত সন্তের চিত্র। আধুনিক যুগের স্যান্টা ক্লজকে প্রথম দেখা যায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিশিষ্ট ক্যারিকেচারিস্ট ও রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট টমাস ন্যাস্টের আঁকায়, পরনে স্যান্টা স্যুট। প্রথমদিকে ছোট ছোট স্যান্টা আঁকতেন ন্যাস্ট, তার কারণ পশ্চিমী প্রথা বলে যে ক্রিসমাসের আগের রাতে চিমনি দিয়ে ঢুকে বাড়িতে উপহার রেখে যান স্যান্টা। ফলে ন্যাস্ট সেই সাইজেরই স্যান্টা আঁকতেন, যাঁদের পক্ষে সুড়ুত করে চিমনি দিয়ে গলে যাওয়া সম্ভব। পরে অবশ্য প্রমাণ সাইজের স্যান্টা ক্লজ আঁকতে শুরু করেন তিনি, এবং তিনিই সর্বপ্রথম স্যান্টাকে লাল রঙের ফার কোট, মাথায় রাতে পরার টুপি, এবং মোটা কালো বেল্ট পরান। ন্যাস্টের আগে তবে কী পরে থাকতেন স্যান্টা? তাঁর পোশাকের রঙ ছিল বাদামী, যাকে লাল করে দেন ন্যাস্ট, যদিও সবুজ পোশাক পরা স্যান্টাও এঁকেছিলেন তিনি। অনেকেই ভুল করে ভাবেন এই আঁকা হ্যাডন সান্ডব্লমের, যিনি ১৯৩১ সাল থেকে কোকা-কোলা কোম্পানির জন্য স্যান্টা এঁকে চলেছিলেন। কিন্তু তার অন্তত ৪০ বছর আগে ‘হারপার্স উইকলি’ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে দেখা যায় লাল জামা পরা স্যান্টাকে। সেকথা স্বীকার করে নিয়েছে স্বয়ং কোকা-কোলা কোম্পানিও। তবে একথা বলাই যায় যে, সান্ডব্লমের কাজের ফলেই আধুনিক যুগে নির্দিষ্ট চেহারা ধারণ করেন স্যান্টা, ন্যাস্টের প্রাথমিক কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান সান্ডব্লম। তবে যেমন আগে বলা হয়েছে, আজও অঞ্চলগত প্রভেদ রয়েছে স্যান্টার পোশাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনে সাধারণভাবে লাল ফার কোট এবং লাল প্যান্ট পরেন স্যান্টা, কোমরে থাকে মোটা কালো বেল্ট, মাথায় লাল টুপি, পায়ে কালো বুটজুতো। কিন্তু ইউরোপের অনেক দেশেই এখনও জনপ্রিয় সেন্ট নিকোলাস, ফলে সেসব দেশে আজও দেখতে পাবেন ক্রিশ্চান সাধকের লম্বা আলখাল্লা পরা স্যান্টা, যাঁর হাতে থাকে বিশপের পবিত্র দণ্ড।
যীশু খ্রিস্টের জীবনী
যীশু ছিলেন একজন ইহুদি ধর্মপ্রচারক। যিনি খ্রিস্টধর্মের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য হন। তিনি নাসরতের যিশু নামেও অভিহিত হন। যিশুকে প্রদত্ত উপাধি ‘খ্রিস্ট’ থেকে খ্রিস্টধর্মের নামকরণ করা হয়েছে। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন, যিশু ইশ্বরের পুত্র এবং বাইবেলের পুরাতন নিয়মে পূর্বব্যক্ত মসিহ যার আগমন নতুন নিয়মে পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। আদি বাইবেল অনুযায়ী ২৫ ডিসেম্বর যীশু খ্রিস্টের জন্ম হয় এবং তখন থেকে এই দিন যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন হিসাবে ধরা হয়। যদিওবা প্রাচীন ইউরোপ মহাদেশের নানা বিদ্রহের মধ্যে লেখা নানান বই থেকে এর তারিখ আলাদা মনে হয়। যীশু একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যিশুকে প্রায়শই ‘রাব্বি’ সম্বোধন করা হয়েছে। তিনি মুখে মুখে তার বাণী প্রচার করতেন। বাপ্তিস্মকর্তা যোহন তাকে বাপ্তিস্ম করেছিলেন এবং রোমান প্রিফেক্ট পন্টিয়াস পাইলেটের আদেশে তাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। আধুনিক যুগে সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, যীশু ছিলেন একজন রহস্যোদ্ঘাটনবাদী ধর্মপ্রচারক এবং তিনি ইহুদি ধর্মের মধ্যেই একটি সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। যদিও কয়েকজন বিশিষ্ট গবেষক মনে করেন যে, যিশু আদৌ রহস্যোদ্ঘাটনবাদী ছিলেন না। ঈশ্বরের ইচ্ছা পালনের শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি কী, তা নিয়ে যিশু ইহুদি ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিতর্কে অংশ নিতেন, রোগীদের রোগমুক্ত করতেন, নীতিগর্ভ কাহিনির মাধ্যমে শিক্ষা দিতেন এবং শিষ্য সংগ্রহ করতেন। যিশুর অনুগামীরা বিশ্বাস করতেন যে, তিনি মৃত্যুর পর পুনর্জীবন লাভ করেছিলেন এবং তারা যে সমাজ গঠন করেছিলেন সেটাই পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় চার্চে পরিণত হয়। ২৫ ডিসেম্বর তারিখে (বা কয়েকটি ইস্টার্ন চার্চের মতানুসারে জানুয়ারির বিভিন্ন তারিখে) যীশুর জন্মদিন পালিত হয়। এটি একটি ছুটির দিন এবং এটি বড়দিন বা ক্রিসমাস নামে পরিচিত। যিশুর ক্রুশারোহণের তারিখটি গুড ফ্রাইডে এবং পুনর্জীবন লাভের তারিখটি ইস্টার নামে পরিচিত। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন যে, বিশ্বে যিশুর একটি ‘স্বতন্ত্র গুরুত্ব’ রয়েছে। খ্রিস্টীয় মতবাদের অন্তর্ভুক্ত বিশ্বাসগুলির মধ্যে রয়েছে পবিত্র আত্মার প্রভাবে যিশুর গর্ভে প্রবেশ এবং মেরি নাম্নী এক কুমারীর গর্ভে জন্ম, যিশুর বিভিন্ন অলৌকিক কার্য সম্পাদন, চার্চ প্রতিষ্ঠা, প্রতিকার বিধানার্থে আত্মত্যাগ স্বরূপ ক্রুশারোহণে মৃত্যু, মৃত অবস্থা থেকে পুনর্জীবন লাভ, সশরীরে স্বর্গে আরোহণ, এবং ভবিষ্যতে তার পুনরাগমনে বিশ্বাস। অধিকাংশ খ্রিস্টানই বিশ্বাস করেন যে, যীশু ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের পুনর্মিলন ঘটানোর শক্তি রাখেন।