মহাশিবরাত্রির মাহাত্ম্য সুদূরপ্রসারী। মহাশিব রাত্রি বা শিবরাত্রি হচ্ছে হিন্দু শৈব সম্প্রদায়ের নিকট একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। এই মহাশিবরাত্রি ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী তিথিতে পালিত হয়। মহাশিবরাত্রি হল হিন্দুধর্মের সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবাদিদেব মহাদেব ‘শিবের মহা রাত্রি’। অন্ধকার আর অজ্ঞতা দূর করার জন্য এই ব্রত পালিত হয়। অগণিত ভক্ত এইদিন শিবলিঙ্গে গঙ্গাজল, দুধ, বেলপাতা, ফুল দিয়ে পূজা করে থাকে। সব ব্রতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল এই মহাশিবরাত্রি। ব্রতের আগের দিন ভক্তগণ নিরামিষ আহার করে। রাতে বিছানায় না শুয়ে মাটিতে শোয়া হয়। ব্রতের দিন তারা উপবাসী থাকে। তারপর রাত্রিবেলা চার প্রহরে শিবলিঙ্গকে দুধ, দই, ঘৃত, মধু ও গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করানো হয়। তারপর বেলপাতা, নীলকন্ঠ ফুল, ধুতুরা, আকন্দ, অপরাজিতা প্রভৃতি ফুল দিয়ে পুজো করা হয়। আর ‘ওঁ নমঃ শিবায়’ এই মহামন্ত্র জপ করা হয় । সেদিন রাত্রি জাগরণ করা হয় ও শিবের ব্রতকথা, মন্ত্র আরাধণা করা হয়। ভারতবর্ষের বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গ তথা সমস্ত শিবমন্দিরে এই পূজা চলে, তান্ত্রিকেরাও এইদিন সিদ্ধিলাভের জন্য বিশেষ সাধনা করে। মহাশিবরাত্রি সাধারণত ইংরাজী মাসের ফেব্রুয়ারি বা মার্চ এ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। হিন্দু মহাপুরাণ তথা শিবমহাপুরাণ অনুসারে এইরাত্রেই শিব সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের মহা তান্ডব নৃত্য করেছিলেন । আবার এইরাত্রেই শিব ও পার্বতীর বিবাহ হয়েছিল । এর নিগুঢ় অর্থ হল শিব ও শক্তি তথা পুরুষ ও আদিশক্তি বা পরাপ্রকৃতির মিলন। এই মহাশিবরাত্রিতে শিব তার প্রতীক লিঙ্গ তথা শিবলিঙ্গ রূপে প্রকাশিত হয়ে জীবের পাপনাশ ও মুক্তির পথ দিয়েছিলেন। যদিও বর্তমান কালে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শোনা যায়, শিবরাত্রি এমন এক ব্রত যেখানে শিবের মত বর পাওয়ার জন্য, স্বামীর মঙ্গলকামনার্থে সমগ্র হিন্দু নারীজাতি সারাদিন উপোস থেকে মহাদেবকে তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। যদিও এটি নিতান্তই ভুল ধারণা। কেবলমাত্র নারী জাতি না, যে কেউই এই পুজো করতে পারেন এবং শুধুমাত্র স্বামীর নয়, সমগ্র জগতের মঙ্গলার্থে এই ব্রত করা যায়। স্কন্ধ, পদ্ম এবং লিঙ্গ পুরাণে এই শিবরাত্রির মাহাত্ম্য নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। শিবরাত্রির উৎস নিয়ে বিভিন্ন পৌরাণিক গল্প প্রচলিত আছে। শিবমহাপুরাণ অনুসারে, অতি প্রাচীনকালে বারাণসী তথা কাশীধামে এক নিষ্ঠুর ব্যাধ বাস করত। একদিন শিকারে বেরিয়ে তার খুব দেরী হওয়ার ফলে সে জঙ্গলে পথ হারিয়ে রাতে এক হীংস্র জন্তুর ভয়ে এক গাছের উপর আশ্রয় নেয় । কোনো শিকার না পেয়ে সে হতাশ হয়ে গাছ থেকে একটা করে পাতা ছিঁড়ে নিচে ফেলতে থাকে। সেই গাছটি ছিল বেলগাছ। আর সেই বেলগাছের নীচে একটি শিবলিঙ্গ ছিল। সেদিন ছিল শিবচতুর্দশী অর্থাৎ মহাশিব রাত্রি। আর ব্যাধও ছিল উপবাসী। তার ফেলা বেলপাতাগুলো শিবলিঙ্গের মাথায় পড়ে এর ফলে তার শিবচতুর্দশী ব্রতের ফল লাভ হয় তার অজান্তেই। পরদিন ব্যাধ বাড়ি ফিরে এলে তার খাবার সে এক অতিথিকে দিয়ে দেয়। এতে তার ব্রতের পারণ ফল লাভ হয়।এর কিছুদিন পরে সেই ব্যাধ মারা গেলে যমদূতরা তাকে নিতে আসে। কিন্তু শিবচতুর্দশী ব্রতের ফল লাভ হেতু শিবদূতরা এসে যুদ্ধ করে যমদূতদের হারিয়ে ব্যাধকে নিয়ে যায়। যমরাজ তখন স্বীকার করেন যে শিবচতুর্দশী ব্রত পালন করে তার উপর যমের কোনো অধিকার থাকেনা। সে মুক্তিলাভ করে। এইভাবে মর্ত্যলোকে শিবচতুর্দশী ব্রতের প্রচার ঘটে। আবার একটি উপাখ্যান অনুসারে মহাদেব শিব যখন তার ত্রিনয়ন বোজান, তখন সারা পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে আসে আর সেই অন্ধকার দূর করতে ভক্তদের শিবরাত্রি পালন করতে হয় শিবের আরাধনা করে। কথিত আছে, একদা ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মধ্যে বিবাদ বাঁধে কে জগৎস্রষ্টা, কে সর্বোত্তম তাই নিয়ে। দুই আদিপুরুষের মধ্যে শুরু হয় ক্ষমতার লড়াই। বিষ্ণু ও ব্রহ্মা পরস্পরকে যথাক্রমে মহাশক্তিশালী মহেশ্বর অস্ত্র ও পাশুপত অস্ত্র নিক্ষেপ করেন। দুই মহা অস্ত্রের সংঘর্ষে সমগ্র সৃষ্টি লয়প্রাপ্ত হওয়ার সময় আসন্ন দেখে দেবতারা শঙ্কিত। সেই মুহূর্তে সমুদ্রের জলরাশি ভেদ করে এক জ্বলন্ত জ্যোতির্ময় স্তম্ভের আবির্ভাব হয়। দুই মহা অস্ত্রের সংঘর্ষে উৎপন্ন বিধ্বংসী অগ্নিশিখা সেই স্তম্ভে সমাহিত হয় এবং সমগ্র সৃষ্টি রক্ষা পায়। কথিত আছে এই স্তম্ভ স্বর্ণ রজত বা পাষাণ নির্মিত নয়, তার না আছে আদি না আছে অন্ত। উদ্ভব হল মহাতেজী জ্যোতির্লিঙ্গের। এর আদি ও অন্ত সন্ধানের জন্য বিষ্ণু বরাহ রূপ নিয়ে পাতালপ্রবেশ করলেন এবং ব্রহ্মা হংসরূপ নিয়ে আকাশপথে গমন করেন। বিষ্ণু ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। কিন্তু ব্রহ্মা দেবত্ব লাভের আশায় মিথ্যার আশ্রয় নেন এবং শিবজটা থেকে পতিত কেতকী ফুলকে তাঁর হয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দানে রাজী করিয়ে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসেন। জ্যোতির্লিঙ্গের অন্ত দর্শন না করেও মিথ্যা বলায় মহাদেব ক্রুদ্ধ হন এবং জ্যোতির্লিঙ্গ থেকে বিভুতিভূষণ, শূল ও দণ্ডপাণি, পিনাকপাণি, সায়ক ও চক্রধারী গঙ্গাধর ওঙ্কারস্বরূপ ভগবান মহেশ্বর আত্মপ্রকাশ করেন। ক্রুদ্ধ ভগবান ব্রহ্মাদেবকে অভিশাপ দেন যে ব্রহ্মাদেব কখনো পূজিত হবেন না, এবং তার নিজস্ব কোনো মন্দির থাকবে না, তবে সমস্ত শুভকর্ম তাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণ থাকবে। মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ায় মহাদেব তাঁর পুজোয় কেতকীফুলের নিবেদন নিষিদ্ধ করেন। পরে দেবতাগণ মহাদেবের এই ভয়ঙ্কর রূপে ভীত হয়ে তাঁর স্তবপাঠ করে তার আদি অন্তহীন লিঙ্গমূর্তিকে সকল সৃষ্টির উৎস মেনে নিলে তিনি শান্ত হন এবং তাঁদের মনস্কামনা পূরণ করেন এবং সেই পুণ্য তিথিকে শিবরাত্রি হিসাবে পালন করার নির্দেশ দেন। আর ব্যাধের বিল্বপত্রাচরণ দিয়ে শিবরাত্রির প্রচলনের গল্প তো আমাদের সকলেরই জানা। তবে শিবরাত্রির উৎস সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত যে দুটি পৌরাণিক গল্প তাদের মধ্যে একটি হল সমুদ্র মন্থনে ওঠা বিষ শিব নিজের কণ্ঠে রেখে মানব্জাতিকে সেই বিষের সংস্পর্শ থেকে রক্ষা করে। শিবরাত্রি হল মহাদেবের বিষপান করে মানবজাতিকে রক্ষা করার কথা মনে রেখে তাঁর প্রতি মানুষের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। আর অন্যটি হল ব্রহ্মা বিষ্ণুর মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই তে শিবের জ্যোতির্লিঙ্গ হিসেবে আবির্ভাব ও সেই লড়াই এ মধ্যস্থতা করাকে স্মরণ করে শিবরাত্রি পালন করা হয়। মহাশিব রাত্রি অনুষ্ঠানে ভারতবর্ষের বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গ তথা সোমনাথ, মল্লিকার্জুন, মহাকালেশ্বর, ওঁকারেশ্বর, কেদারনাথ, ভীমশঙ্কর, বিশ্বেশ্বর, ত্র্যয়ম্বকেশ্বর, বৈদ্যনাথ, নাগেশ্বর, রামেশ্বর ও ঘুশ্মেশ্বর এ বহু মানুষের সমাগম হয় ও সবার হাতে এই জ্যোতির্লিঙ্গের পূজা ও পবিত্র স্পর্শলাভ ঘটে। আলেকজান্ডার কানিংহ্যাম ১৮৮৪ সালে তার গ্রন্থে বর্ণনা করে গেছেন কিভাবে মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহোতে এই শিবরাত্রির দিন ঘটা করে শিব-পার্বতীর বিবাহ উৎসব পালন করা হয়। তামিলনাড়ুর থিল্লাই নটরাজ মন্দিরে এই দিন নাট্যাঞ্জলি নৃত্য উৎসব পালন হয়। নাচের মাধ্যমে এইদিন শিবের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। কাশ্মীরে এইদিনটিকে ‘হেরাথ’ বলে। তান্ত্রিক সূত্রে এই দিনটিকে ভৈরব ও ভৈরবী দের আরাধনার মাধ্যমে ‘ভৈরব উৎসব’ পালন করার কথা বলা হয়েছে। আশা করি, মহাশিবরাত্রির উৎস, মাহাত্ম্য ও ফলাফল সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করতে পারলাম।