চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন কিংবদন্তি পরিচালক তরুণ মজুমদার। দীর্ঘ ১৩ দিনের লড়াই শেষ করে আজ সব শান্ত। সকাল ১১.২০তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন কিংবদন্তি পরিচালক তরুণ মজুমদার । বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে৷ দীর্ঘদিন ধরেই বয়সজনিত কারণে ভুগছিলেন তিনি৷ ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে৷ শেষ হল দীর্ঘ একটা অধ্যায় ৷ বাংলা সংস্কৃতি জগৎ হারাল আরও এক কিংবদন্তিকে ৷ বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একটি যুগের অবসান ঘটল। বিগত কয়েকদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন তরুণ মজুমদার। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন পরিচালক। সঙ্কটজনক হলেও স্থিতিশীল ছিল তাঁর শারীরিক অবস্থা। কিন্তু রবিবার হঠাৎই ফের শারীরিক অবনতি হয় তাঁর। হঠাৎ সেকেন্ডারি ইনফেকশন হয় বর্ষীয়ান পরিচালকের। জানা যাচ্ছে, শনিবার থেকেই তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছিল। রবিবার দ্রুত শরীর খারাপ হয়ে পড়ায় শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তরুণ মজুমদারের। তখনই তাঁকে ভেন্টিলেশনে দিতে হয়। রক্তে ক্রিয়েটিনিন এর মাত্রা অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। ৯২ বছর বয়সে একদিকে বয়স জনিত রোগে ভুগছিলেন তিনি ৷ গত ২২ বছর ধরে কিডনির সমস্যায় আক্রান্ত, হাই ডায়াবেটিসও রয়েছে তাঁর ৷ তার সঙ্গে নতুন করে ফুসফুসের সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। ৫ জন চিকিৎসকের মেডিক্যাল বোর্ড তৈরি করা হয়৷ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সৌমিত্র ঘোষ এবং চেস্ট মেডিসিনের সোমনাথ কুন্ডু-র তত্ত্বাবধানে ছিলেন তরুণ মজুমদার ৷ ১৯৩১ সালে পূর্ববঙ্গের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম ৷ পড়াশোনা শেষ করে সিনেমার বিজ্ঞাপনের কাজ করলেও নজর ছিল পরিচালনায় ৷ ততদিনে বাঙালি দেখে ফেলেছে পথের পাঁচালী ৷ দর্শকদের মজিয়ে রেখেছেন উত্তর-সুচিত্রা ৷ এরই মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়ালেন নতুন পরিচালক ৷ ১৯৫৯ সালে তরুণ মজুমদারের পরিচালনায় প্রথম মুক্তি পেল উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘চাওয়া পাওয়া’ ৷ তবে তাঁকে প্রথম জাতীয় পুরস্কার এনে দেয় 1962 সালে ‘কাঁচের স্বর্গ’৷ বাংলা ছবিতে তরুণ মজুমদার রবীন্দ্রসঙ্গীতকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না ৷ দর্শককে একাধিক হিট ছবি উপহার দিয়েছেন । পলাতক, নিমন্ত্রণ, সংসার সীমান্তে, গণদেবতা, বালিকা বধূ, কুহেলী, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, ফুলেশ্বরী, দাদার কীর্তি, ভালোবাসা ভালোবাসা, পরশমণি, আলো এবং সাম্প্রতিককালে ভালোবাসার বাড়ি ৷ ‘ভালোবাসার বাড়ি’তে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর সঙ্গে জুটি বেঁধেছিলেন বাংলা টেলিভিশনের আজকের জনপ্রিয় অভিনেতা প্রতীক সেন । বর্ষীয়ান পরিচালককে ঘিরে আবেগে ভেসে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বলেছিলেন, “ওঁর মতো এনার্জেটিক মানুষ বিরল । এই বয়সেও এতটুকু ক্লান্ত হতে দেখিনি তাঁকে । ইউনিটের সবাই ক্লান্ত হয়ে গেলেও তিনি ক্লান্ত হতেন না কখনও ।” পদ্মশ্রীর পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকটি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তরুণ মজুমদার । চারটি জাতীয় পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে । এ ছাড়াও রয়েছে ৭টি বিএফজেএ পুরস্কার, ৫টি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড ৷ তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র বানানোর উদ্যোগ নিয়েছেন বাম যুবনেতা শতরূপ ঘোষ । কিংবদন্তির প্রয়াণে শোকাহত টলিউড ৷ তাঁর মৃত্যুতে শোকবার্তা দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । লিখেছেন, “বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক তরুণ মজুমদারের প্রয়াণে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। তিনি আজ কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। ভিন্নধারার রুচিসম্মত সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাণে তরুণ মজুমদার উজ্জ্বল নিদর্শন রেখে গেছেন। তাঁর ছবিতে রবীন্দ্রসংগীতের প্রয়োগ দর্শককে আবিষ্ট করে রাখে। তরুণ মজুমদার পরিচালিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র , বালিকা বধূ, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, ফুলেশ্বরী, দাদার কীর্তি, ভালবাসা ভালবাসা, সংসার সীমান্তে, গণদেবতা, শহর থেকে দূরে, পথভোলা, চাঁদের বাড়ি, আলো ইত্যাদি উল্লেখের দাবি রাখে। তিনি পদ্মশ্রী, জাতীয় পুরস্কার, বিএফজেএ পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড-সহ বিভিন্ন পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। তাঁর প্রয়াণ চলচ্চিত্র জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমি তরুণ মজুমদারের পরিবার-পরিজন ও অনুরাগীদের আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।”