করোনার অতিমারী উত্তর পর্বে সিনে জগতের হাল বেশ বেহালই ছিল। তবে ২০২৩-এর শুরু থেকেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে বলিউড। চলতি বছর প্রেক্ষাগ্রহ ও ওটিটি মাধ্যমে মুক্তি পায় প্রায় দেড় শতাধিক বলিউড সিনেমা। যার ভেতর কয়েক ডজন সিনেমা বক্স অফিস মাত করেছে। এমনকি ডজনখানেক সিনেমা আয়ের দিক দিয়ে রীতিমতো রেকর্ড গড়েছে। এর বাইরে ব্যবসায়িক সফলতার মুখ না দেখলেও অনেক সিনেমাই অর্জন করেছে অসংখ্য পুরস্কার এবং কুড়িয়েছে চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের প্রশংসা। বলিউডের কোন ছবিগুলো ধামাকা করল বক্স অফিসে বছরে শেষে আরও একবার ফিরে দেখা যাক –
পাঠান
বক্স অফিসে রেকর্ড গড়ার সূত্রপাত করেন বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খান। চার বছর পর বড় পর্দায় ফিরে কিং খান যেন সুপারম্যানের মতো উড়তে শুরু করেছিলেন ‘পাঠান’ সিনেমা দিয়ে। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি মুক্তি পাওয়া সিদ্ধার্থ আনন্দ পরিচালিত সিনেমাটি প্রথম দিন ৫৬ কোটির ব্যবসা। বিশ্বজুড়ে, ১০৫০ কোটির আয় পেয়েছিল এই ছবি। এবছরের প্রথম ছবি হিসেবে ১০০০ কোটির ক্লাবে পৌঁছায় পাঠান। অভিনয়ে ছিলেন, দীপিকা পাডুকোন, জন আব্রাহাম, আশুতোষ রানা।
গদর ২
অভিনেতা সানি দেওলও বুড়ো হাড়ের ভেলকি দেখিয়েছেন ‘গদর ২’ দিয়ে। ভারত পাক সম্পর্কের নিরিখে নির্মিত এই ছবি কামাল করে বক্স অফিসে। এই ছবি বিশ্বজুড়ে, প্রায় ৬৯১ কোটির আয় করে। যা সানি দেওলের ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ আয়ের সিনেমা। সানির সঙ্গে অভিনয়ে ছিলেন আমিশা প্যাটেল।
জওয়ান
তবে এখানেই থেমে থাকেননি কিং খান। বছরের সবচেয়ে বেশি আয় করা ‘জওয়ান’ সিনেমাটিও এখন তার দখলে। গত ৭ সেপ্টেম্বর মুক্তি পাওয়া অ্যাটলি কুমারের সিনেমাটি ১১৪৮ কোটির বিশ্বজুড়ে ব্যবসা করে। টেক্কা দেয় পাঠানকে। প্রথমদিন, ৬৫ কোটির ব্যবসা করে এই ছবি। পিছিয়ে যায়, বাহুবলী, KGF 2, এবং RRR কে। নয়নতারা, বিজয় সেতুপতি, দীপিকা পাডুকোন অভিনয় করেছেন এই ছবিতে।
রকি অর রানি কি প্রেমকাহানি
চলতি বছর বক্স অফিস কাঁপিয়ে দেয় আলিয়া ভাট-রণবীর সিংয়ের ‘রকি অর রানি কি প্রেমকাহানি’। এই ছবি বিশ্বজুড়ে, ব্যবসা করেছে ৩৫৫ কোটির।
টাইগার থ্রি
‘টাইগার থ্রি’ দিয়ে ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে এ বছরই বেরিয়ে আসেন সালমান খান। রেকর্ড আয় করে দেখিয়ে দেন তিনি এখনো ফুরিয়ে যাননি।
লিও
থালাপতি বিজয় এবং তৃষা কৃষ্ণান জুটির এই ছবি এবারের বিরাট হিট। এই ছবি দক্ষিণের ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম। ব্যবসা করেছে প্রায় ৬৫০ কোটির। পরিবার, থ্রিলার, এবং রোমাঞ্চে ভরপুর এই ছবি।
জেলার
সুপারস্টার থালাইভা রজনীকান্তের ছবি রিলিজ করবে আর সেটি হিট করবে না এও আবার হয়। তাঁর স্ক্রিন উপস্থিতি মানেই বিরাট ব্যাপার। এই ছবি দেশের ষষ্ঠ হিট ছবি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে এই বছর। একজন জেলার যিনি নিজের কর্মের ক্ষেত্রে সৎ নিষ্ঠাবান। একজন ক্রিমিনালকে আটকাতে সে সব করতে পারে। উপার্জন করেছে, ৬৩৩ কোটি টাকা।
অ্যানিমেল
চলতি মাসে ‘অ্যানিমেল’ দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন অভিনেতা রণবীর কাপুর। সন্দীপ রেড্ডি পরিচালিত এ সিনেমা দর্শককে মুগ্ধ করে বক্স অফিসে বছরের সর্বোচ্চ আয়ের তালিকায় তৃতীয় স্থানে জায়গা করে নিয়েছে। সন্দীপ রেড্ডি পরিচালিত এই ছবি রণবীর কাপুরকে ফের একবার সিলভার স্ক্রিন এক্সপার্ট করে তুলেছে। ভায়োলেন্স, রোম্যান্স এবং রণবীরের অভিনয় মুগ্ধ করেছে সকলকে। সঙ্গে, ববি দেওলের প্রেসেন্স না বললেই নয়। তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে অনন্য হয়ে উঠেছেন এই ছবিতে। বিশ্বজুড়ে ব্যবসা করেছে ৮৩৫+ কোটির।
শাম বাহাদুর
ভিকি কৌশল অভিনীত এই ছবি ফিল্ড মার্শাল শাম বাহাদুরের বায়োপিক। মেঘনা গুলজার পরিচালিত এই ছবি রিলিজ করে অ্যানিম্যালের সঙ্গে। যদিও এটি ভিকির ক্ষেত্রে এই বছরের বিরাট হিট হতে চলেছে। তবে, বিশ্বজুড়ে এই ছবির আয় ১০৫ কোটি।
ডাঙ্কি
এর বাইরের বছরের শেষে নতুন করে ‘ডানকি’ দিয়ে ঝড় তুলেছেন শাহরুখ। যা এখন অবধি চলছেই।
সালার
সুপার ফ্লপ আদিপুরুষ, কিন্তু প্রভাস ফিরলেন। সালার দিয়ে জীবনের অন্যতম ইতিহাস তৈরির করার মুখে তিনি। ২২ তারিখ রিলিজ করার পরেই ঝড় উঠল। এরমধ্যেই ৫০০ কোটির ব্যবসা করে ফেলেছেন তিনি। দক্ষিণী তারকার অ্যাকশন দেখতে হলমুখী মানুষ।
এছাড়াও আয়ুষ্মান খুরানা ও অনন্যা পান্ডের ‘ডিমগার্ল টু’, রণবীর কাপুর ও শ্রদ্ধা কাপুরের ‘তু জুথি মে মক্কার’সহ বেশ কয়েকটি সিনেমা বক্স অফিসে প্রভাব ফেলার পাশাপাশি মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে বলিউড সিনেমার।
শুধু তাই নয়, প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি না পাওয়া অনেক সিনেমাও পুরস্কার ও প্রশংসা অর্জন করেছেন চলতি বছর। সেই তালিকার শুরুতেই রয়েছে মনোজ বাজপেয়ীর ‘জোরাম’, ‘সিরফ এক বান্দা কাফি হ্যায়’ সিনেমাগুলো। আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল রটারডম, সিডনি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ডারবান আর্ন্তজাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, বুসান আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, সিকাগো আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশ নিয়ে দারুণ প্রশংসিত হয় জোরাম।
এছাড়া জি ফাইভে মুক্তি পাওয়া ‘সিরফ এক বান্দা কাফি হ্যায়’ সিনেমাটিও চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের নজর কাড়ে। অন্যদিকে, এই তালিকা থেকে বাদ যায়নি ‘ভেদ’, টুয়েভ ফেইল’, ‘কস্তুরি’ ‘খুপিয়া’, ‘ধাক ধাক’, ‘ও এমজি টু, ‘গোল্ড ফিশ’, শ্যাম বাহাদুরের মতো সিনেমাগুলো।
তবে সব ভালোর মধ্যেও বেশ কিছু সিনেমা এ বছর তৈরি হয়েছে যেগুলোকে কেবলমাত্র জঞ্জাল ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। যেমন এই তালিকায় রয়েছে ৬০০ কোটি বাজেটের ওম রাউত পরিচালিত ‘আদিপুরুষ’। এই ছবিতে দেখা গিয়েছিল যেমন রদ্দিমার্কা সংলাপ তেমনই উপস্থাপন। আধুনিকীকরণ করার প্রচেষ্টায় রাবণের লঙ্কায় লিফট দেখানো থেকে শুরু করে লঙ্কারাজের দোতলা মাথা। উপরন্তু হনুমানের মুখে বাপ-বাপান্ত সংলাপ বসিয়ে ওম রাউত নিজেই খাল কেটে বিতর্কের কুমির বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এমনকি প্রভাস-কৃতীকেও কম অপমানিত হতে হয়নি সোশাল মিডিয়া জুড়ে।
এর পর ফেরা যাক সলমন খানের বহু প্রতীক্ষিত সিনেমা ‘কিসি কা ভাই কিসি কি জান’-এর দিকে। তেইশের অন্যতম বিগ বাজেট সিনেমা। বছরখানেক বাদে এই সিনেমা নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলেন সলমন ভক্তরা। কিন্তু সেই আশায় এক্কেবারে জল ঢেলে দিয়েছেন ভাইজান। পর্দায় ভাইজানের ইয়াব্বড় চুল আর অদ্ভূতমার্কা সংলাপ বলার ধরণ শুনে বেজায় বিরক্ত হয়েছে দর্শকমহল। পরে অবশ্য ‘টাইগার ৩’র সুবাদে কিছুটা ড্যামেজ কন্ট্রোল হয়েছে।
বিকাশ বহেল পরিচালিত ‘গণপত’ দেখা সময় নষ্ট ছাড়া কিছুই নয়। টাইগার শ্রফ, কৃতী শ্যানন এবং অমিতাভ বচ্চনের মতো অভিনেতাকে কাস্ট করেও সুপারফ্লপ।
একই অবস্থা কার্তিক আরিয়ান এবং কৃতী স্যানন অভিনীত শেহজাদার। দক্ষিণী সিনেমার রিমেক হলেও চিত্রনাট্য, গল্পের বাঁধন অত্যন্ত খাঁজা! তারকাদের অভিনয়ও মাঝারি মানের।
‘দ্য ভ্যাকসিন ওয়ার’ ছবিতে বাস্তব ঘটনা দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী। কিন্তু পক্ষপাতীত্ব করতে গিয়ে মিথ্যের ঝুড়ি খুলে বসেন পরিচালক। করোনাকালে ভারতের বিজ্ঞানীদের জয়গান গাইতে গিয়ে প্রথমসারির অন্য যোদ্ধাদের যেভাবে নিচু করে দেখিয়েছেন পরিচালক টা সত্যিই নিন্দনীয়।
১৯৮৯ সালে রানিগঞ্জ কয়লাখনির দুর্ঘটনার প্রেক্ষাপটে ভুলতে বসা অতীত মনে করাতে চেয়েছিলেন অক্ষয় কুমার। কিন্তু ‘মিশন রানিগঞ্জ’ ছবিতে অধিক মশলা প্রয়োগ করেই বাস্তব নষ্ট করে দেন অভিনেতা।
‘ইয়ারিয়া ২’ ছবিটি এক্কেবারেই কোনও জায়গা করে নিতে পারেনি দর্শক মনে। মালয়ালম ছবির দুরন্ত চিত্রনাট্য বলিউডের হাতে পড়ে হয়ে গিয়েছে দুর্বল। ততোধিক খারাপ দিব্যা কুমার খোসলা, মেজান জাফরি, পার্ল ভি পুরী, প্রিয়া প্রকাশ ওয়ারিয়ার, ওয়ারিনা হুসেনদের অভিনয়! সকলেই আড়ষ্ট। প্রথম বলিউড ছবিতেই শূন্য পেলেন যশ দাশগুপ্ত।
এবছরও ফ্লপ তকমা ঘোচাতে পারলেন না কঙ্গনা রানাউত! দেশপ্রেমের রানওয়েতেও মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছে ‘তেজস’কে।
বহুকাল বাদে অর্জুন কাপুরের একটা সিনেমা রিলিজ করেছে ২০২৩ সালে। কিন্তু ‘লেডি কিলার’ এতটাই খারাপ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে যে এই পরিসরে অতিরিক্ত দু-চার শব্দ প্রয়োগ করাও সময় ব্যায়ের সমান। সিনেজঞ্জালের শেষপাতে যে সিনেমা দুটির নাম না করলেই নয়, সেটা হল UT69 – Based On A True Story এবং থ্যাংক ইউ ফর কামিং। পর্নকাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়া রাজ কুন্দ্রার ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্যই একটি সিনেমা তৈরি করেছেন তিনি। অভিনয়ও নিজেই করেছেন। যা কিনা বসে দেখাও ধৈর্যের পরীক্ষা।