পুজো

কালীপুজোর ইতিহাস এবং পৌরাণিক ব্যাখ্যা! জেনে নিন পুজোর নির্ঘণ্ট

কালী দশ মহাবিদ্যার প্রথম দেবী। হিন্দু পঞ্জিকার অশ্বযুজা মাসের বা কার্তিক মাসের দীপান্বিতা অমাবস্যা পালিত হয়। উৎসবটি বিশেষ করে  পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, আসাম  এবং ত্রিপুরার মতো অন্যান্য স্থানের পাশাপাশি  বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয় । এ দিন দীপাবলি উৎসব পালিত হয়। এটি দীপাবলি, দীপান্বিতা, দীপালিকা, সুখরাত্রি, সুখসুপ্তিকা এবং যক্ষরাত্রি নামেও অভিহিত হয়। সারা বছর অমাবস্যা তিথিতে মা কালীর বিভিন্ন রূপের পুজো হয়। যেমন – ফলহারিনী অমাবস্যা থেকে কৌশিকী অমাবস্যা, বিভিন্ন সময়ে দেবীর বিভিন্ন রূপের পুজো করা হয়। এছাড়া মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে রটন্তী এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিতে ফলহারিণী কালীপুজোও যথেষ্ট জনপ্রিয়।কালীপুজোর নিয়ম বেশ কঠিন। বেশ রাতে পুজো হয়। ভক্তরা দিনভর উপবাসের পরে মা কালীর পুজো দেন। মা কালীর পুজোয় নানা নিয়ম রয়েছে। দীর্ঘক্ষণ ধরে চলে পূজার্চনা। এমনকি কালীপুজোয় অনেক জায়গায় এখনও বলি দেওয়ার প্রথা প্রচলিত রয়েছে। বাংলার বাঙালিরা, যারা কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীপুজো করেন না, তাঁরা অনেকেই কার্তিক অমাবস্যায় মা লক্ষ্মীর পুজো করেন। অমাবস্যা তিথিকে পূজিতা হন দেবী লক্ষ্মী এবং গণেশ। এই পুজোকে দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো বলা হয়। অবাঙালিরা এদিন লক্ষ্মী ও গণেশের পুজো করেন। বাংলায় কালীপুজোর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মন্দিরের পাশাপাশি অনেকেই বাড়িতেও কালীপুজো হয়। অনেকে আবার এই দীপাবলিতে বাড়িতে লক্ষ্মী-গণেশের পুজো করেন। দুর্গাপূজার মতো কালীপূজাতেও গৃহে বা মণ্ডপে মৃন্ময়ী প্রতিমা নির্মাণ করে পুজো করা হয়। মন্দিরে বা গৃহে প্রতিষ্ঠিত প্রস্তরময়ী বা ধাতুপ্রতিমাতেও কালীপুজো করা হয়। মধ্যরাতে তান্ত্রিক পদ্ধতিতে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে পুজো অনুষ্ঠিত হয়। দেবীকে ছিন্নমস্তক সহ বলির পশুর রক্ত, মিষ্টান্ন, অন্ন বা লুচি, মাছ ও মাংস উৎসর্গ করা হয়। গৃহস্থবাড়িতে সাধারণত অতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যমতে আদ্যাশক্তি কালীর রূপে কালীর পুজো হয়। দেবীর পুজোয় ছাগ মেষ বা মহিষ বলির প্রথা রয়েছে। সুদূর অতীতে নরবলি দিয়েও কালীপুজো হত। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, কালী শ্মশানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। এই কারণে কলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে শ্মশানে মহাধুমধামসহ শ্মশানকালী পুজো অনুষ্ঠিত হয়। কোনো কোনো মণ্ডপে কালী ও শিবের মূর্তির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার দুই বিখ্যাত কালীসাধক রামকৃষ্ণ পরমহংস ও বামাখ্যাপার মূর্তিও পূজিত হয়। কোথাও কোথাও কালীর সঙ্গে সঙ্গে দশমহাবিদ্যাও পূজিত হন। কালীপুজোর রাতে গৃহে আলোকসজ্জা সাজানো হয় এবং আতসবাজি পোড়ানো হয়। শাস্ত্র মতে, মা কালী ১১ রূপের আলাদা আলাদা মাহাত্ম্য রয়েছে। কালীপুজো বা দিপাবলীর এই আরাধনাকে শ্যামা পুজো বা মহানিশি পুজোও বলা হয়। কার্ত্তিক অমাবস্যার রাতে কালীপুজো করা হয়। দেখে নিন এ বছরের কালীপুজোর শুভ সময়। প্রতি বছর কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে কালীপুজো হয়। পঞ্জিকা মতে নিশিতা কালে(মধ্যরাতে) এই পুজো হয়। এ বছর কার্ত্তিক অমাবস্যা পড়েছে ৩১ অক্টোবর (১৪ কার্তিক), বৃহস্পতিবার। অমাবস্যা তিথিঃ ৩১ অক্টোবর, ঘ ৩/৭/৪২ থেকে ১ নভেম্বর সন্ধ্যা ৫/৮/৭ মিনিট পর্যন্ত অমাবস্যা তিথি থাকবে। ৩১ অক্টোবর ৩:৫২ মিনিটে অমাবস্যা তিথি শুরু হবে। পরের দিন অর্থাৎ ১ নভেম্বর ১২:৪৮ মিনিটে অমাবস্যা ছাড়বে। কালীপুজো মধ্যরাত্রি পর্যন্ত চলে, শুরুও হয় রাতেই, তাই ৩১ অক্টোবর পুজো হবে। কালীপুজোর শুভ মুহূর্ত ৩১ অক্টোবর ১১:৪৮ মিনিট থেকে ১ নভেম্বর ১২:৪৮ মিনিট পর্যন্ত।

শক্তির আরাধ্য দেবী কালীর উগ্র ও ভয়ংকর রূপ সৃষ্টির পেছনে আছে পৌরাণিক কারণ। ভারতে কালীপুজোর উত্‍পত্তি বিকাশ এবং প্রচলন প্রথা সম্পর্কে নানান তথ্য চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। সেই সকল তথ্য কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা কিন্তু বলা খুব মুশকিল। অতীত ঘাঁটলে তার উত্‍পত্তি সম্পর্কে নানান তথ্য আমরা পেয়ে থাকি। কালী মায়ের রূপের বর্ণনা আমরা সাধারণত কালীর যে রূপের দর্শন পাই, তিনি চতুর্ভূজা অর্থাত্‍ তার চারটি হাতযুক্ত মূর্তি । খড়গ, অন্যটিতে অসুর মুণ্ড অন্য হাতগুলিতে তিনি বর এবং অভয় প্রদান করেন। গলায় নরমুণ্ডের মালা, প্রতিকৃতি ঘন কালো বর্ণের এবং রক্তবর্ণ জিভ মুখ থেকে বাইরের দিকে বেরিয়ে আছে । এছাড়াও তিনি এলোকেশি। মা কালীকে দেখা যায় শিবের বুকের উপর পা দিয়ে জিভ বার করে দাঁড়িয়ে আছেন। কালী পূজার কালী শব্দটি কাল শব্দের স্ত্রীর রূপ, যার অর্থ হল কৃষ্ণ বর্ণ বা গুরু বর্ণ। বিভিন্ন পুরাণ থেকে থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মহামায়া মা দুর্গার অন্য একটি রূপ হল কালী। প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী কালী একটি দানবীর রূপ। মহাভারতে কালীর উল্লেখ রয়েছে, সেখানে যোদ্ধা এবং পশুদের আত্মা বহন করেন যিনি, সেই তিনিই কাল রাত্রি কালী নামে পরিচিত। জানা যায়, নবদ্বীপের এক তান্ত্রিক যার নাম কৃষ্ণানন্দ তিনি বাংলায় প্রথম কালীমূর্তি বা প্রতিমা পূজার প্রচলন করেন। তার আগে মা কালীর উপাসকরা তাম্র পটে বা খোদাই করে কালীর মূর্তি এঁকে মা কালী সাধনা করতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালী পূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন এবং এইভাবে মা কালীর প্রতিমা পূজার প্রচলন শুরু। উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার বিভিন্ন ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপুজোর ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়।

পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন দক্ষিণা কালী, শ্মশান কালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী ,গ্রহ কালী, চামুণ্ডা, ছিন্নমস্তা প্রভৃতি। মহাকাল সংহিতা অনুসারে মা কালীর আবার নব রূপের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন কাল কালী, কঙ্কাল কালী, চিকা কালী এমন সব রূপের রূপের পরিচয়ও পাওয়া যায়। এছাড়াও বিভিন্ন মন্দিরে ব্রহ্মময়ী , আনন্দময়ী, ভবতারিণী, আনন্দময়ী ইত্যাদি নামেও মা কালীর পুজো বা উপাসনা করতে দেখা যায়। কালী পূজার সময়কাল দুর্গাপুজোর পরবর্তী অমাবস্যাতে দীপান্বিতা কালী পুজো করা হয়। এছাড়াও মাঘ মাসে রটন্তি কালীপুজো এবং জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী কালীপূজা ধুমধাম করে অনুষ্ঠিত করা হয়। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যায় এছাড়াও বিভিন্ন সিদ্ধ অমাবস্যায় এছাড়াও বিভিন্ন সিদ্ধ পিঠে প্রতিদিন এবং প্রতি শনি ও মঙ্গলবার মা কালী পুজোর প্রচলন দেখা যায়।

বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুসারে: অমাবস্যা শুরু– বাংলা: ১৪ কার্তিক, বৃহস্পতিবার। ইংরেজি: ৩১ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার। সময়: দুপুর ৩টে ৫৪ মিনিট।

রাত ১০টা ৫৬ মিনিট গতে ১১টা ৪৪ মিনিটের মধ্যে শ্যামাপুজো, কালীপুজো, মা তারার আবির্ভাব।

অমাবস্যা শেষ– বাংলা- ১৫ কার্তিক, শুক্রবার। ইংরেজি: ১ নভেম্বর, শুক্রবার। সময়: সন্ধ্যা ৬টা ১৭ মিনিট।

গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা অনুসারে: অমাবস্যা শুরু- বাংলা: ১৪ কার্তিক, বৃহস্পতিবার। ইংরেজি: ৩১ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার। সময়: দুপুর ৩টে ৭ মিনিট ৪৩ সেকেন্ড।

অমাবস্যা শেষ– বাংলা: ১৫ কার্তিক, শুক্রবার। ইংরেজি: ১ নভেম্বর, শুক্রবার। সময়: সন্ধ্যা ৫টা ৮ মিনিট ৭ সেকেন্ড।