বিবিধ

মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস

একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জনগণের গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। আবার এটি শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বলেও পরিচিত। পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভাষা-বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে এ নিয়ে সীমিত পর্যায়ে আন্দোলন হয় এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তার চরম প্রকাশ ঘটে। ঐদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালামসহ ৮জন ছাত্রযুবা হতাহত হন। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী ২১ তারিখে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে নিহতের সংখ্যা ৩ জন, আহত ৩০০ জন ও গ্রেফতার ১৮০ জন, ২৩ ফেব্রুয়ারির সংবাদপত্রে পরিবেশিত তথ্য থেকে জানা যায়, নিহত ৫ জন, আহত ১২৫ জন ও গ্রেফতার ৩০ জন, ২৪ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সভা থেকে সরকারকে ৭৫  ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়ে যে পত্র দেয়া হয়, তাতে ৩৯ জন শহিদ হয়েছেন বলে দাবি করা হয় (এবং ওই সভায়  ৫ মার্চ ‘শহিদ দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়)। ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টায় লেখা একুশের প্রথম কবিতায় মাহবুব উল আলম চৌধুরী বলেছেন- ‘ওরা চল্লিশ জন কিংবা আরো বেশী/যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রৌদ্রদগ্ধ/কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়/ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য বাংলার জন্য/যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে’; প্রভাত ফেরিতে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর যে গান আমরা গাই , তাতে তিনি লিখেছেন- ‘ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি। এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হয়। নানা নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে। তারা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহিদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় অংশগ্রহণ করে। ভাষাশহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যা সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি গুঁড়িয়ে দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। ১৯৮৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন বিল’ পাশ হয়। যা কার্যকর হয় ৮ মার্চ ১৯৮৭ সাল থেকে।  ভাষা আন্দোলনে ২১ শে ফেব্রুয়ারির সেই ৮ জন শহিদের পরিচিতি এখানে তুলে ধরা হলো

১) আবুল বরকত

শহীদ হয়েছেন ২১-২-১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ

পরিচয় : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এমএ ক্লাসের ছাত্র।

পিতার নাম : মৌলভী শামসুজ্জোহা ওরফে ভুলু মিয়া (১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু)

মাতার নাম : হাজী হাসিনা বিবি (১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু)

তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে আবুল বরকত ছিলেন পিতামাতার চতুর্থ সন্তান।

জন্ম : ১৬ জুন ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ, জন্মস্থান : গ্রাম-বাবলা ভরতপুর, জেলা : মুর্শিদাবাদ, রাষ্ট্র : ভারত।

ঢাকার ঠিকানা : বিষ্ণু প্রিয়া ভবন, পুরানা পল্টন, ঢাকা। 

২) আবদুল জব্বার

শহিদ হয়েছেন ২১-২-১৯৫২ সালে, পরিচয় : সাধারণ গ্রামীণ কর্মজীবী মানুষ ছিলেন, পিতার নাম : মরহুম হাছেন আলী (১৯৭২ সালে মৃত্যু), মাতার নাম : সফাতুন্নেসা (১৯৮৫ সালে মৃত্যু)

পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আবদুল জব্বার ছিলেন দ্বিতীয়। আবদুল জব্বারের স্ত্রীর নাম আমেনা খাতুন ও তার একমাত্র ছেলের নাম নূরল ইসলাম বাদল (১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ভাষা আন্দোলনের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৫ মাস)

জন্ম : ১৩ আগস্ট ১৯১৯ সালে

জন্মস্থান : পাঁচুয়া, ইউনিয়ন : রাওনা, উপজেলা : গফরগাঁও, জেলা : ময়মনসিংহ।

৩) রফিক উদ্দীন আহমদ

শহিদ হয়েছে ২১-২-১৯৫২ সালে

পরিচয় : মানিকগঞ্জ জেলার দেবেন্দ্রনাথ কলেজের বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয়  বর্ষের ছাত্র।

পিতার নাম : মরহুম আবদুল লতিফ (১৯৬২ সালে মৃত্যু), মাতার নাম : রাফিজা খানম (মৃত্যু ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে), জন্ম : ৩০ অক্টোবর ১৯২৬ সালে, গ্রাম : পারিল, উপজেলা : সিঙ্গাইর, জেলা : মানিকগঞ্জ।

রফিক উদ্দীন আহমদের ছোট ভাইয়ের নাম খোরশেদ আলম, তিনি এখনো জীবিত। শহিদ রফিক উদ্দীন আহমদ ২০০০ সালে মরণোত্তর একুশে পদক পান।

৪) আবদুস সালাম

গুলিবিদ্ধ হন ২১-২-১৯৫২ সালে। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ৭-৪-১৯৫২ সালে বেলা ১১টায় মৃত্যুবরণ করেন।

পরিচয়: ডাইরেক্টর অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অফিসে রেকর্ড কিপার পদে চাকরি করতেন।

পিতার নাম : মরহুম মো. ফাজিল মিয়া (১৯৭৬ সালে মৃত্যু)

মাতার নাম : দৌলতন নেছা (১৯৮২ সালে মৃত্যু) 

তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে আবদুস সালাম ছিলেন সবার বড়। তার সবচেয়ে ছোট ভাই এখনো জীবিত।

জন্ম : ২৭ নভেম্বর ১৯২৫ সালে, জন্মস্থান : গ্রাম : লক্ষণপুর, ইউনিয়ন : মাতৃভূঞা, থানা : দাগনভূঞা, জেলা : ফেনী।

৫) শফিউর রহমান

শহিদ হয়েছেন ২২-২-১৯৫২ সালে

পরিচয় : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ক্লাসের প্রাইভেট ছাত্র ও ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী। বংশাল রোডের মাথায় শহিদ হন (ঢাকা)।

পিতার নাম : মরহুম মাহবুবুর রহমান

মাতার নাম : মরহুমা কানেতাতুন্নেসা

শফিউর রহমানের স্ত্রীর নাম আকিলা খাতুন (বর্তমানে জীবিত বয়স আনুমানিক ৮৩ বছর)। শফিউরের ছেলের নাম শফিকুর রহমান ও মেয়ের নাম আসফিয়া খাতুন। বর্তমানে তারা সবাই উত্তরা মডেল টাউনের বাসিন্দা।

জন্ম : ২৪ জানুয়ারি ১৯১৮ সালে, জন্মস্থান : গ্রাম : কোন্নাগর, জেলা : হুগলি, রাষ্ট্র ঃ ভারত।

ঢাকার ঠিকানা : হেমেন্দ্রনাথ রোড, ঢাকা। ১৯৯০ সালে শহিদ শফিউর রহমানকে মরণোত্তর একুশে পদক দেয়া হয়।

৬) আবদুল আউয়াল

শহিদ হয়েছেন ২২-২-১৯৫২ সালে। (বর্তমান ঢাকা রেল হাসপাতাল কর্মচারী সংলগ্ন এলাকায় সশস্ত্র বাহিনীর মোটর গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু)।

পরিচয় : রিকশাচালক, পিতার নাম : মো. আবদুল হাশেম, জন্ম : ১১ মার্চ ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ (আনুমানিক), জন্মস্থান : সম্ভবত গেন্ডারিয়া, ঢাকা।

৭) মো. অহিউল্লাহ

শহিদ হয়েছেন ২২-২-১৯৫২ সালে। ঢাকার নবাবপুর এলাকার বংশাল রোডের মাথায় সশস্ত্র পুলিশের গুলিতে নিহত হন এবং তার লাশ পুলিশ অপহরণ করে।

পরিচয় : শিশু শ্রমিক, পিতার নাম : হাবিবুর রহমান, পিতার পেশা : রাজমিস্ত্রি, জন্ম : ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪১ সালে (আনুমানিক), জন্মস্থান : অজ্ঞাত

৮) অজ্ঞাত বালক

শহিদ হয়েছেন ২২-২-১৯৫২ সালে