অম্বুবাচী হিন্দু ধর্মের একটি অতি প্রাচীন পার্বণ। এই পার্বণ ঘিরে যেমন ধার্মিক বিশ্বাস রয়েছে তেমনই জড়িয়ে রয়েছে প্রকৃতিকে আরাধনা। সনাতন হিন্দু ধর্মের একটি উৎসব হল অম্বুবাচী। আষাঢ় মাসে মৃগশিরা নক্ষত্রের তৃতীয় পদ শেষ হয়ে চতুর্থ পদের শুরুতে অম্বুবাচী শুরু হয়। তার পর থেকে তিন দিন অম্বুবাচীর আচার পালন করা হয়। ‘অম্বুবাচী’ শব্দটি এসেছে অমাবতী থেকে। এই নামেও মা বা নারী শক্তির বার্তা আসে। অম্বুবাচীর এই তিনদিন সন্ন্যাসী এবং বিধবারা বিশেষ ভাবে পালন করেন। ফলে ধরিত্রীর উপর এঁরা কাঠ কয়লা বা আগুন জ্বালান না। যাতে ধরিত্রীর কষ্ট হয়। সেই মতে বিশ্বাসী হয়ে এই ৩ দিন ফলাহার করে কাটান এঁরা। এই তিনদিন মন্দির বন্ধ রাখা হয়। পুজোপাঠও নিষিদ্ধ থাকে এই সময়। বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় এই অম্বুবাচী, ‘অমাবতী’ বলেও পরিচিত। এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শাস্ত্রের নানা কাহিনী। শাস্ত্রে বলে, এই দিন সূর্যদেব আর্দ্রা নক্ষত্রের প্রথম পদে অবস্থান করলে রাশিচক্রের মিথুন রাশির সময়কালে ধরিত্রী ঋতুমতী হন। আর এই সময়কালই হল অম্বুবাচী। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে বলা হয়, ধরিত্রী মা ঋতুমতী হওয়ার কারণে ভূমিকর্ষণ ও বৃক্ষরোপণ করা নিষিদ্ধ। মনে করা হয় এই তিন দিনে গৃহ প্রবেশ, বিবাহ ও অন্যান্য শুভ কাজ করা উচিত নয়। যেহেতু এই কয়েকদিন মা ঋতুমতী থাকেন তাই বলা হয় এই সময় যৌন সংসর্গও অনুচিত। মা ঋতুমতী হলে তবেই ধরিত্রী শস্য শ্যামলা হবে, ফসল ফলবে। ধরিত্রী মায়ের সঙ্গে মেয়েদেরও তুলনা করা হয়। সে কারণেই এই কয়েকদিন যৌন সংগম থেকে বিরত থাকাই ভালো। কারণ মেয়েরা ঋতুমতী হলে তবেই সন্তান ধারণে সক্ষম হন। মেয়েরাই তো আলোর উৎস। এছাড়াও কামাক্ষ্যা কামের দেবী হিসেবে পরিচিত। মহাভারত , ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ , নীল তন্ত্র, রুদ্রযামল , শিবচরিত, শাক্তানন্দ-তরঙ্গিণী এবং মহাপীঠ নিরূপণ ও মঙ্গলকাব্যের সূত্র ধরে বলা যায় , সতীর ৫১ খন্ডের একটি খণ্ড এই কামাক্ষা ধামে পতিত হয়েছিল সেটি হলো সতীর অঙ্গের “যোনি” খণ্ড , তাই এই পীঠস্থান কে শ্রেষ্ঠ পীঠ বলা হয়ে থাকে এবং এর জন্যে কামেশ্বরীও বলা হয়ে থাকে। তাই অম্বুবাচীতে কামাক্ষা ধামে যোনী শিলা হতে এখনো পর্যন্ত অদ্ভুত ধরনের লাল জলের ধারা বইতে দেখা যায় এবং ওই জল ব্রহ্মপুত্র নদে বয়ে যেতে দেখা যায় । ফলে তখন ব্রহ্মপুত্রের জলও লাল হয়ে যায়। তাই এই সময় পৃথিবীর সমস্ত জলরাশি অপবিত্র থাকে। আর এই অম্বুবাচী তিথি পর্যন্ত সর্বত্রই ঝিরিঝিরি বা কখনও মুষলধারে বৃষ্টি হয়। ঠিক যেমনটা হয় রজস্রাবের সময়ে।এছাড়াও আরও যা যা বলা হয়-
১) হিন্দু শাস্ত্র মতে, এই সময়ে অন্য কোনও বিশেষ পুজোর আয়োজন না করাই ভালো। তবে, কোনও কোনও বছর এই সময়ে রথযাত্রার উৎসব পড়লে, তা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই করা যেতে পারে। কারণ রথযাত্রাকে নিত্যকর্ম হিসাবেই ধরা হয়।
২) যাঁরা আদি শক্তির বিভিন্ন রূপ পুজো করেন, যেমন মা কালী, দেবী দুর্গা, দেবী জগদ্ধাত্রী, মা বিপত্তারিণী,মা শীতলা, দেবী চণ্ডীর মূর্তি বা পট পুজো করেন, তাঁরা এই সময়ে মূর্তি বা পট লাল কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখবেন।
৩) অম্বুবাচীর দিনগুলিতে পুজোর সময়ে কোনও মন্ত্র পাঠ করবেন না, কেবল ধূপ ও দ্বীপ সহযোগে ঠাকুর প্রণাম করবেন।
৪) অম্বুবাচীতে দেবীর মূর্তি বা পট কখনওই স্পর্শ করা উচিত নয় বলে মনে করে হিন্দু শাস্ত্র।
৫) অম্বুবাচীতে গুরুর পুজা চলতে পারে। কারওর গুরু যদি নারী হন, অর্থাৎ গুরুমা হন, তাহলেও পুজো চলতে পারে, তাতে কোনও দোষ নেই বলে মনে করে হিন্দুশাস্ত্র ।
৬) যাঁরা শাক্তমন্ত্রে দীক্ষিত, তাঁরা এইসময়ে গুরুমন্ত্র জপ করতে পারবেন। হিন্দুশাস্ত্র মতে জপে কোনও দোষ নেই বলে মনে করা হয়।
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুসারে অম্বুবাচী শুরু
বাংলার ৭ আষাঢ়, মঙ্গলবার। ইংরেজির ২২ জুন সকাল ৫টা ৩৯ মিনিট থেকে। শেষ হবে বাংলার ১০ আষাঢ়, শুক্রবার অথাৎ ইংরেজির ২৫ জুন, শুক্রবার। সন্ধে ৫টা ৩৪ মিনিটে।
গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা মতে অম্বুবাচী শুরু
বাংলার ৭ আষাঢ়, মঙ্গলবার। ইংরেজির ২২ জুন। সময় রাত ২টো ০৫ মিনিট ৩৯ সেকেন্ডে।
অম্বুবাচী শেষ হচ্ছে বাংলা ১০ আষাঢ়, শুক্রবার ইংরেজির ২৫ জুন রাত ২টো ২৮ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডে।