আজ থেকে শুরু হল ২৭ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। নজরুল মঞ্চে উদ্বোধন হয়ে গেল ২৭ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের। গত ২৭ জানুয়ারি চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার বাড়বাড়ন্তে তখন স্থগিত হয় উৎসব। প্রত্যেক বারের মতোই এবারও তারকাদের মেলা বসেছিল এই চলচ্চিত্র উৎসবে। উদ্বোধন করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী প্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ও জুন মালিয়া। এদিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বলিউড অভিনেতা তথা সাংসদ শত্রুঘ্ন সিনহা ও তাঁর স্ত্রী পুনম সিনহা। এছাড়াও মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্রনীল সেন, সন্দীপ রায়, গৌতম ঘোষ, হরনাথ চক্রবর্তী, সোহম চক্রবর্তী, শ্বাশত চট্টোপাধ্যায়, অরিন্দম শীল, নুসরত জাহান, শতাব্দী রায়, দেব, পাওলি দাম, রাজ চক্রবর্তী, শুভশ্রী গাঙ্গুলি, কৌশানী মুখোপাধ্যায়, সায়নী ঘোষ, সুদেষ্ণা রায়, মমতা শঙ্কর, কোয়েল মল্লিক, শকুন্তলা বড়ুয়া, অনামিকা সাহা, বাবুল সুপ্রিয় সহ আরও অনেকে। এবছরে থালি গার্লের ভূমিকা পালন করেছেন সায়ন্তিকা ব্যানার্জি। উৎসবের চেয়ারপর্সন পরিচালক রাজ চক্রবর্তী জানান, এবছরের চলচ্চিত্র উৎসবে ৪০ টি দেশের ১৬৩ টি ছবি দেখানোর কথা। এবারের উৎসবের কেন্দ্রীয় দেশ হিসেবে রয়েছে ফিনল্যান্ড। তাদের মোট ৭টি ছবি দেখানো হবে। ৭ দিন ধরে কলকাতার ১০টি প্রেক্ষাগৃহে এই উৎসব চলবে। চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংযুক্ত শিল্পী যাঁরা গত বছরে প্রয়াত হয়েছেন তাঁদের শ্রদ্ধা জানানো হবে। তাঁদের মধ্যে আছেন দিলীপ কুমার, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, বাপ্পি লাহিড়ী, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, অভিষেক চট্টোপাধ্যায়। উদ্বোধনী চলচ্চিত্র হিসেবে দেখা হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের ছবি অরণ্যের দিনরাত্রি। ১ মে সমাপ্তি অনুষ্ঠান হবে রবীন্দ্রসদনে। অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘গতবার কোভিডের মধ্যেও চেষ্টা করেছিলাম চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করতে। এবারও হওয়ার কথা ছিল না, সবাই বলছিল হবে না হবে না হবে না। আমি বলেছিলাম হবে হবে হবে। শেষে আজ শুরুও হ্যে গেল। বাংলা সিনেমার জৌলুস এখন অনেক বেড়েছে। ১৬৩টি সিনেমা দেখানো হবে এবারের চলচ্চিত্র উৎসবে। সহযোগী দেশ ফিনল্যান্ডকে ধন্যবাদ। লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, বাপ্পি লাহিড়ী, অভিষেক চট্টোপাধ্যায় আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। এদের কথা আজ খুব মনে পড়ছে। আমি বঙ্গবিভূষণ দিতে চেয়েছিলাম লতাজিকে মুম্বইতে গিয়ে। কিন্তু সেই সুযোগ হল না। সন্ধ্যাদি এত ভালো শিল্পী হয়েও আমার কাছে গান শুনতে চাইতেন। বাপ্পিদার মনটা অনেক বড় ছিল। খুব দু:খ পাই, যখন তাঁদের কথা মনে পড়ে। কিছুদিন আগে অভিষেকও চলে গেল। বাংলায় কী নেই! বারুইপুরে ১০ একর জমির ওপর টেলি অ্যাকাডেমি তৈরি করেছি। বাংলা চলচ্চিত্র বিশ্বের সেরা চলচ্চিত্র। পুরনো বাংলা ছবি সংরক্ষণ করা হচ্ছে। বাংলা চলচ্চিত্রের উন্নতিতে কাজ করছি। অনেকগুলি নতুন স্টুডিও তৈরি করেছি। সিনে মিউজিয়াম তৈরি
হচ্ছে। পরের বার বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে ফিল্ম দুনিয়াকেও আমন্ত্রণ জানানো হবে।’ “আমি মানিকদার ভক্ত ছিলাম, আছি এবং থাকব”, ২৭তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঝরঝরে বাংলায় ওই মন্তব্য করলেন ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কিংবদন্তী অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহা। এদিন মঞ্চে বক্তব্য রাখতে এসে তিনি জানান, অস্কারজয়ী পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয়ের ইচ্ছা ছিল তাঁর। সিনিয়র শটগানের কথায়, “মুম্বই ইন্ডাস্ট্রির গ্রেট শো ম্যান রাজ কাপুরকে আমি বরাবরই পছন্দ করতাম। আমি ওঁর দিওয়ানা। একইভাবে বাংলা থুড়ি ভারত থুড়ি গোটা বিশ্বের চলচ্চিত্রের নিরিখে আমি মানিকদার ভক্ত ছিলাম। মানিকদার ভক্ত আছি এবং আজীবন মানিকদার ভক্ত থাকব।” তিনি এও বলেন, “মানিকদার সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা ছিল। ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছাও ছিল। এখন তো এসব অধরা স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে।” এরপরেই অতীতের নস্টালজিয়ায় ফিরে যান তিনি। মৃণাল সেন এবং ঋত্বিক ঘটক -দের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “FTII -এ পড়ার সময় আমি কলকাতাকে সেন্টার হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। সে সময় সিলেক্টরের আসনে ছিলেন কালজয়ী পরিচালক মৃণাল সেন। আমি ‘সো কলড স্টার’ হওয়ার পর অনেকেই আমাকে মহান অভিনেতা বলতেন। আমার মতে আমি মহান অভিনেতা নই। কিন্তু, যাঁদের অভিনেতা হিসেবে আমাকে ভালো লাগত না, তাঁদের বলেই দিতাম যে সিলেকশন মৃণালদা করেছিলেন। ওঁর সঙ্গে বাকিটা বুঝে নিন।” তিনি আরও বলেন, “বাংলার আরও এক মহান চলচ্চিত্র নির্মাতাকে আমি চিনতাম। FTII -এর ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন তিনি। তিনি ‘মেঘে ঢাকা তারা’ খ্যাত প্রবাদপ্রতিম পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। ওঁদের কাছ থেকে শিখেছি আমি। ওঁরা আমাদের শিক্ষক ছিলেন। মানিকদাও তো অনেকবার FTII -এ এসেছেন। মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর, অশোক কুমার, কানাইয়ালালদের কাছ থেকে শিখেছি। জিনিয়াস উৎপল দত্ত, পাহাড়ি সান্যালদের মতো অভিনেতারা ছিলেন এখানে।” এদিন অন্তর্জলি যাত্রা’-র প্রসঙ্গ টেনে অভিনেতা আরও বলেন, “বাংলার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বহুদিনের। সকলেই জানেন পরিচালক গৌতম ঘোষের সঙ্গে আমার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ওঁকে আমি আমার গুরুও মানি। ২৫০টিরও বেশি ছবিতে আমি কাজ করেছি। তবে সবচেয়ে বেশি শিখেছি গৌতম ঘোষের সঙ্গে কাজ করার সময়।” বর্তমান বাংলা চলচ্চিত্র জগত সম্পর্কে এদিন শত্রুঘ্ন বলেন, “রঞ্জিতবাবুকে তো আমরা দেখেছি। এখন প্রসেনজিৎ তো দারুন কাজ করেছে। আমি ওঁকে ছোট দেখেছি। দারুন কাজ করছে এখন। সন্দীপ রায়ের ছবি আমি দেখতে চাই।” তিনি আরও বলেন, “২৫ বছর ধরে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব করছেন আপনারা। আশা করি, আমাকে এর অংশ হয়ে উঠতে দেবেন। আমি বরাবর ভালো সিনেমার পৃষ্ঠপোষক। বলা চলে, ভালো সিনেমা আমাকেও উৎসাহিত করেছে। অন্তর্জলি যাত্রা, পতংয়ের মতো ছবিতে কাজ করেছি।” রাজ্য সরকারকে অভিনেতার পরামর্শ, “শুধুমাত্র ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটা মন্ত্রক থাকা উচিত। যেটা শুধুমাত্র ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির তত্ত্বাবধান করবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুরোধ করব বিষয়টি নিয়ে ভাবতে।” অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘যাঁরা সিনেমা দেখতে চান, তাঁদের কোথাও একটা কষ্ট হচ্ছিল, কারণ এই উৎসবটা হয়নি। কেন হয়নি সেই কারণটা সবাই জানি। এই উৎসবের জন্য আমিও অপেক্ষা করে থাকি। বেশ ভালো লাগছে সেটা আবার ফিরে আসায়।’