জুনে লোকসভা ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর বসিরহাট কেন্দ্রের জয় নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, তিনি নিজে সন্দেশখালি যাবেন জনতাকে ধন্যবাদ জানাতে। সেকথা রাখলেন নেত্রী। বছরশেষে সন্দেশখালি গেলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সন্দেশখালির অরবিন্দ মিশন মাঠে প্রশাসনিক সভা থেকে সরকারি পরিষেবা প্রদান করলেন। একগুচ্ছ উন্নয়ন প্রকল্পের কথা ঘোষণা করলেন। বছরের প্রথম দিকে রাজ্যকে নাড়িয়ে দিয়েছিল সন্দেশখালির ঘটনা। সেখানে ইডি আধিকারিকদের উপরে হামলা ও পরে তৃণমূল নেতা শাহজাহান গ্রেফতার হন। তারপরেই উঠে আসতে থাকে সেখানকার তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর অভিযোগ। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে গোটা সন্দেশখালি। সেই সময় এলাকার মানুষজনের দাবি ছিল একবার অন্তত সেখানে যান মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার সেই সন্দেশখালিতে দাঁড়িয়েই বিরোধীদের নিশানা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উদ্বোধন করলেন ১২৩ কোটি টাকার ৬৬টি প্রকল্পেরও। প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় আরও মহকুমা তৈরির কথা বললেন তিনি। বললেন দ্বীপাঞ্চল সন্দেশখালিতে ফেরিঘাট, লঞ্চ, সেতুর উন্নয়নের কথা। ৬৬টি প্রকল্পের জন্য ১২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করলেন। বোঝালেন, উন্নয়নের স্রোতে স্রেফ ভেসে যায় যে কোনও রাজনৈতিক চাল। প্রশাসনিক কাজকর্মের সুবিধার জন্য বড় জেলাগুলিতে আগেও নতুন নতুন মহকুমা তৈরি হয়েছে। হয়েছে পুলিশ জেলাও। সেদিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে সন্দেশখালি। সরকারি কাজকর্মের জন্য কমবেশি ঘণ্টাখানেকের দূরত্ব অতিক্রম করতে হয় বাসিন্দাদের। যদিও সন্দেশখালিতে ব্লক অফিস আছে। নিকটবর্তী মহকুমা বসিরহাট, যা বেশ খানিকটা দূরে। এসব মাথায় উত্তর ২৪ পরগনায় জেলায় আরও একটি মহকুমা তৈরির ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। সন্দেশখালি ২ নম্বর ব্লকের ঝুপখালি, বেড়মজুর ১ নম্বর ও ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে নতুন সংযোগকারী সেতু তৈরি হবে। সন্দেশখালি গ্রামীণ হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৬০ করার ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। এদিন সন্দেশখালি থেকে মুখ্যমন্ত্রী আরও ঘোষণা করেন, নতুন বছরে রাজ্যের দুর্গম এলাকায় দুয়ারে সরকার হবে। ২৬ জানুয়ারির পর থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পর্যন্ত চলবে এই প্রকল্প। যার মাধ্যমে জনগণ নিজেদের জরুরি কাজ করে নিতে পারবেন। সে অর্থে সন্দেশখালির মতো দ্বীপ ঘেরা অঞ্চল দুর্গম। এখানকার বাসিন্দারাও দুয়ারে সরকারের মাধ্যমে পরিষেবা পাবেন। সন্দেশখালিতে প্রশাসনিক সভা থেকে ২০২৬ ভোটের প্রচার শুরু করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, আগামী দেড় বছরের মধ্যে বাকি ১৬ লক্ষ মানুষের জন্য পাকা বাড়ির ব্যবস্থা করবেন তিনি। রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা ২০২৬ সালের এপ্রিলে। অর্থাৎ চতুর্থবার ক্ষমতায় এলে বাকি ১৬ লক্ষ মানুষের জন্য পাকা বাড়ির প্রতিশ্রুতি দিলেন মমতা। এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘বাংলার বাড়ি প্রকল্প দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় সরকার চালাচ্ছিল। এখন আমাদের কোনও ট্যাক্স নেই। একটাই ট্যাক্স, সেটা হল জিএসটি ট্যাক্স। যে টাকাটা কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য থেকে তুলে নিয়ে যায়। একটা শাড়ি কিনতে গেলেও GST নেয়। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলোও GST নেয়। সেই ট্যাক্সগুলো নিয়ে চলে যায়। সেই টাকার থেকে আমরা যে টাকা পাই তার থেকে বাংলার বাড়িকে ৩ বছর ধরে ওরা টাকা দেয় না।’ এর পর রাজ্যে আবাস যোজনায় পাকা বাড়ি তৈরির পরিসংখ্যান তুলে ধরেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আবাসন প্রকল্পে আমরা গরমেন্টের টাকায় ইতিমধ্যে প্রায় ৪৭ লক্ষ বাড়ি তৈরি করেছি। শুধু রাজ্য সরকারের টাকায়। আমরা একটা সার্ভে করেছিলাম। তাতে ২৮ লক্ষ মানুষের নাম এসেছিল যারা অত্যন্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলের সত্যিই গরিব। তাদের মধ্যে ১২ লক্ষ মানুষের কাছে তাদের ৫০ শতাংশ টাকা ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে। বাকিটা আগামী ৬ মাসের মধ্যে কাজ শেষ করলেই তারা পাবে। তাহলে বাকি থাকবে ১৬ লক্ষ মানুষকে আমি বলব, ঘাবড়াবেন না। আমি আগামী দেড় বছরের মধ্যে এই ১৬ লক্ষ বাড়ির ব্যবস্থাও করে দেব। যাতে আপনারা একটা মাথা গোঁজার স্থান পান। এই জেলাতেও ৫৬ হাজার মানুষ বাড়ি পেয়েছে।’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিশ্রুতি অনুসারে সরকারি ঘরের জন্য যারা প্রথম কিস্তির টাকা পেয়েছেন তারা বাকি টাকা পাবেন ভোট ঘোষণার কয়েক মাস আগে। আর চতুর্থবার ক্ষমতায় এলে ১৬ লক্ষ বাড়ি তৈরির টাকা দেবে তাঁর সরকার। সন্দেশখালিতে অভিযোগ উঠেছিল, এলাকার মহিলাদের যখন তখন তৃণমূলের পার্টি অফিসে ডাকা হত। তাদের উপরে নির্যাতন চলাতে হত। সেই প্রসঙ্গ না টেনেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমি জানি এখানে টাকার অংকে খেলা হয়েছে ৷ পরে দেখলেন তো সবটাই ভাওতা ৷ মিথ্যে বেশিদিন চলে না ৷ মিথ্যে তো একদিন প্রকাশ পায় ৷ আমি চাই যা হয়েছে সব ভুলে যেতে ৷ আমার মনে নেই। আমি ভুলে গিয়েছি ৷ আমি চাই সন্দেশখালির ছেলেমেয়েরা এক নম্বর জায়গায় যাক ৷ তাঁরা ভারতবর্ষে এক নম্বর হোক ৷” এ দিন মঞ্চ থেকে মমতা সন্দেশখালির মহিলাদের উদ্দেশে বার্তায় বলেন, “কেউ ডাকলেই চলে যাবেন না ৷ বিজেপির টাকার প্রলোভনে পা দেবেন না ৷ দুষ্টু লোকের খপ্পড়ে পড়বেন না ৷ প্রশাসন যা করার দুয়ারে সরকারের মাধ্যমেই করবে ৷ প্রয়োজনে আপনার দরজায় আসবে ৷ তারা আপনাদের ব্যাপারটা দেখবে ৷” তবে, একবছর আগে নারী নির্যাতন ও জমি দখল-সহ নানা অভিযোগ উঠেছিল শেখ শাহজাহান ও তাঁর বাহিনীর বিরুদ্ধে ৷ সেই ইস্যুতে সরাসরি না-হলেও, মহিলাদের উদ্দেশে মমতার বার্তা, “মেয়েরা, কেউ ডাকল আর চলে গেলেন, এমনটা করবেন না ৷ আপনাদের অধিকার, আপনাদের নিজস্ব ৷” বিভিন্ন প্রকল্প ঘোষণার সূত্রে, কাটমানি ইস্যুতে সন্দেশখালির মানুষকে সতর্ক করলেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ তিনি বলেন, “রাজ্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য টাকা দিচ্ছে ৷ কিন্তু, কেউ টাকা চাইলে আপনারা দেবেন না ৷ আমরা যে টাকা দিচ্ছি, তার জন্য কোনও পয়সা কাউকে দেওয়ার দরকার নেই ৷ কারণ টাকাটা সরকারের ৷ আপনি পাচ্ছেন সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে ৷ তাই কেউ চাইলেও টাকা দেবে না ৷ এটা আপনাদের অধিকার ৷” প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকা বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগে ফের কেন্দ্রকে নিশানা করেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ তিনি, “আজ যেটার নাম বাংলার বাড়ি, সেটাই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের আওতায় ছিল প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা ৷ দীর্ঘদিন এই প্রকল্পের জন্য টাকা দেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার ৷ এখন রাজ্যের হাতে কোনও ট্যাক্স নেই ৷ একটাই ট্যাক্স, জিএসটি ৷ যে টাকাটা কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য থেকে তুলে নিয়ে যায় ৷ …সেই টাকা থেকে আমরা যা পাই, তা দিয়ে বাংলার বাড়ি প্রকল্পে খরচ করছি ৷”