পুজো

ছট পুজোর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য!

হিন্দুধর্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব ‘ছট পুজো’।  বছরে দু’টি ছট হয়, একটা হয় চৈত্র মাসে, অন্যটা কার্তিক মাসে ৷ ছট অর্থাৎ ছটা বা রশ্মির পুজো। ছট মহাপর্বের সূচনা হয় স্নান ও খাওয়ার মাধ্যমে। এই উপবাসকে খুবই কঠিন বলে মনে করা হয়, এই উপবাসে মহিলারা একটানা ৩৬ ঘণ্টা উপবাস রাখেন। সাধারণত ছট পুজোর সঙ্গে জড়িত মা গঙ্গা ও অন্নপূর্ণা। কিন্তু হিন্দুরা সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে এই পুজো করে থাকে। স্বাভাবিকভাবে এখনও হিন্দুরা নিজেদের উন্নতি, সম্পদ ও প্রভাব বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘ছট পূজো’ করে থাকে। সূর্য সাধারণত জীবন-শৈলীর কারক। সমস্ত শক্তির উৎস এই সূর্য, তাই এই পুজোতে মনুষ্য জাতি সূর্যদেবকে পুজো অর্চনার মাধ্যমে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে থাকে। চারদিন ধরে এই পুজো হয়ে থাকে। ছট পুজো কার্ত্তিক মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে অনুষ্ঠিত হয়। অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে সাধারণত এই পুজো হয়ে থাকে। আবার কোথাও কোথাও চৈত্র মাসেও হয়। ছট পর্ব সম্পর্কে বহু কাহিনী প্রচলিত আছে। মহাভারতের কাহিনী অনুসারে অনেকে মনে করেন, অঙ্গদেশের রাজ হওয়ার পর সূর্যপুত্র কর্ণ ধুমধাম করে সূর্য দেবের পুজো শুরু করেন ৷ অর্থাৎ, মহাভারতে কুন্তির দ্বারা সূর্যের আরাধনা এবং কর্ণের থেকেই এই পর্বের সূচনা। সেই আচার-অনুষ্ঠানই পরবর্তীকালে ছট পুজো নামে পরিচিত হয় ৷ আবার পুরাণে অন্য একটি কথা প্রচলিত আছে। প্রিয়ব্রত নামে এক রাজার দীর্ঘদিন সন্তান না হলে অনেক যজ্ঞ করে একটি মৃত পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। হঠাৎ সেখানে আসীন দেবী উদয় হন, বলেন আমি ষষ্ঠী দেবী, আমি বিশ্বের সমস্ত শিশুর রক্ষা করি। তারপর মৃত শিশুর শরীর স্পর্শ করেন এবং শিশুটি বেঁচে ওঠে। দেবীর এই কৃপায় রাজা খুব খুশি হলেন এবং তিনি ষষ্ঠী দেবীর পুজো প্রচলন করলেন। এর পরেই ধীরে ধীরে এই পুজো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা করা হয়। এরপর রাজ্যে ব্রত করার নির্দেশ দেন রাজা। এই ব্রতে তিন দিনের কঠোর উপবাসের বিধান রয়েছে। যারা এই ব্রত করেন, তাদের পঞ্চমীর দিন নুন ছাড়া ভোজন গ্রহণ করতে হয়। ষষ্ঠীতে নির্জলা থেকে ব্রত করতে হয়। ষষ্ঠীতে অস্তগামী সূর্যের এবং সপ্তমীর সকালে উদিত সূর্যকে অর্ঘ্য নিবেদন করতে হয়। কোনও নদী বা পুকুরে গিয়ে এই পুজো করতে হয়। তারপর জল খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করতে হয়। আবার এটাও মনে করা হয়, ছট দেবী সূর্য দেবের বোন। তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য সূর্যের আরাধনা করা হয়।

ছট পুজোর তিথি

আস্থার মহোৎসব ছট কার্তিক চতুর্থী তিথি থেকে শুরু হয়১৭ নভেম্বর ছট পুজোর প্রথম দিন। এদিনটিতে স্নান ও খাওয়া সংক্রান্ত এক বিশেষ রীতি পালিত হয়। ১৭ নভেম্বর সূর্যোদয় হবে ৬টা ৪৫ মিনিটে এবং সূর্যাস্ত হবে ৫টা ২৭ মিনিটে। ছট পুজোর দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ পঞ্চমী তিথিতে পালিত হয় খরনা১৮ নভেম্বর খরনা। এদিন ভোর ৬টা ৪৬ মিনিটে সূর্যোদয় হবে। সূর্যাস্ত হবে সন্ধ্যা ৫টা ২৬ মিনিটে। কার্তিক মাসের ষষ্ঠী তিথির সূচনা হবে ১৮ নভেম্বর শনিবার সকাল ৯টা ১৮ মিনিট থেকে। পরের দিন ১৯ নভেম্বর সকাল ৭টা ২৩ মিনিটে ষষ্ঠী তিথি সমাপ্ত হবে। উদয়া তিথি অনুযায়ী ১৯ নভেম্বর ছট পুজো পালিত হবে।

ছট পুজোর সন্ধ্যা অর্ঘ্যের তারিখ ও সময়

ষষ্ঠী তিথিতেই প্রধান পুজো করা হয়ে থাকে। যাঁরা উপবাস করেন তাঁরা এই তিথিতে কোনও নদী, পুকুর বা জলাশয়ে গিয়ে নিয়মপালন করে পুজো করেন। তার পর অস্ত যাওয়া সূর্যকে অর্ঘ্য দেন। চলতি বছর ১৯ নভেম্বর ছট পুজোর সন্ধ্যা অর্ঘ্য় দেওয়া হবে। ১৯ নভেম্বর সন্ধ্যা ৫টা ২৬ মিনিটে সূর্যাস্ত। এটিই সূর্যকে অর্ঘ্য দেওয়ার উপযুক্ত সময়।

ছট পুজোর ভোরের অর্ঘ্যের তারিখ ও সময়

ছট পুজোর চতুর্থ ও শেষ দিনে উদিত সূর্যকে অর্ঘ্য দেওয়ার মাধ্যমে পুজো সম্পন্ন করা হয়। কার্তিক শুক্ল সপ্তমী তিথিতে উদিত সূর্যকে অর্ঘ্য দেওয়ার প্রথা প্রচলিত রয়েছে। এ দিনই ব্রতপারণ করা হয়ে থাকে। ২০ নভেম্বর উদিত সূর্যকে অর্ঘ্য দেওয়ার সময়ে ৬টা ৪৭ মিনিট।

ছট পুজোর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য

ছট পুজো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের একটি জনপ্রিয় উৎসব। এটিই একমাত্র উৎসব যেখানে সূর্য দেবতার পুজো করা হয় এবং তাকে অর্ঘ্য নিবেদন করা হয়। হিন্দু ধর্মে সূর্য পুজোর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তিনিই একমাত্র দেবতা যাকে সরাসরি দেখা যায়। বেদে সূর্যকে জগতের আত্মা বলা হয়েছে। সূর্যের আলোর অনেক রোগ ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে। সূর্যের শুভ প্রভাবে ব্যক্তি স্বাস্থ্য, গতি এবং আত্মবিশ্বাস লাভ করে। বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্রে সূর্যকে আত্মা, পিতা, পূর্বপুরুষ, সম্মান এবং উচ্চ সরকারি চাকরির কারক বলা হয়েছে। ছট পুজোয় সূর্য দেবতা ও ছটি মাতা অর্থাত্‍ ষষ্ঠী দেবীর পুজো করলে সন্তান, সুখ ও কাঙ্খিত ফল পাওয়া যায়। সাংস্কৃতিকভাবে ছট উৎসবের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এর সরলতা, পবিত্রতা এবং প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা।

ছট পুজোর বিশেষত্ব

এই পুজোর বিশেষত্ব হল, বাড়ির যেকোনো সদস্য এই ব্রত করতে পারে। ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে নির্জলা উপবাস করা হয়। সপ্তমী তিথিতে পূর্বের আকাশে উদিত সূর্যকে অর্ঘ্য দেওয়ার মাধ্যমে এই পুজো সম্পন্ন হয়। ছট পুজো মাহাত্ম্যএই সময় বাড়ি পরিষ্কার রাখতে হয়। মোট তিনদিন নির্জলা উপবাস করেন পূণ্যার্থীরা ৷ প্রথম দিন স্নান সেরে, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে নিরামিষ খেতে হয় ৷ একে বলে ‘নাহায়-খায়’ ৷ পরদিন থেকে শুরু হয় উপবাস ৷ সকাল থেকে নির্জলা উপবাস করে সূর্যাস্তের পর ক্ষীরের খাবার খান সকলে ৷ একে বলে খরনা ৷ পরের দিন সূর্যাস্তের আগে নদীতে নেমে সূর্যদেবকে পুজো করতে হয় ৷ সূর্য দেবকে নানা উপাচারে পুজো করা হয় ৷ একে বলে সন্ধ্যা অর্ঘ্য ৷ এর পরের দিন, অর্থাৎ শেষ দিনে সূর্যোদয়ের আগে ঘাটে গিয়ে সূর্যদেবের পুজো করে তাঁকে নানা অর্ঘ্য অর্পণ করা হয় ৷ একে বলে ঊষা অর্ঘ্য ৷ এই পুজোর বিশেষ প্রসাদ ঠেকুয়া। তবে প্রসাদ হিসাবে খাওয়া হয়, ঠেকুয়া, ভাতের নাড়ু, ক্ষীর, গুড়, মিষ্টি ইত্যাদি ৷ । স্ত্রীরা স্বামীর মঙ্গল কামনার জন্য ছট পুজোর গেরুয়া সিঁদুর পড়েন। ছট পুজোর উপবাস করা ব্যক্তিকে পাঁচটি ফল দান করুন, সুফল পাবেন।