জেলা

ধুলিয়ানের ক্যাম্পাসেই তৈরি মুর্শিদাবাদের অশান্তির নীল নকশা ছক! মহারাষ্ট্রের বিতর্কিত সংগঠন থেকে এসেছিল ৬ মূল ‘চক্রী’, ষড়যন্ত্রের বাজেট ছিল প্রায় ২০ কোটি

মুর্শিদাবাদে ভয়াবহ অশান্তি কার্যত রাজ্যের দুঁদে গোয়েন্দাদের কপালেও চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন এমন মারমুখি আচমকা হওয়া কি সম্ভব? একাধিক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে হামলার পেছনে একেবারে পেশাদারি ছক রয়েছে। এমনকী কোন জায়গায় পুলিশকে আটকে দিয়ে কোন জায়গায় হামলা চালাতে হবে তারও নিপুন ছক। ওয়াকফ আইন বিরোধিতাকে মাধ্যম করে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন প্রান্তে ‘দুষ্কৃতী’রা যে তাণ্ডব চালিয়েছে, তার ‘নীল নকশা’ তৈরি হয়েছিল ধুলিয়ানের এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে! গত বছরের অক্টোবর মাসে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই হাঙ্গামা, পুলিসকে আক্রমণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলার ষড়যন্ত্রের ‘বীজ বপন’ করা হয়েছিল। অপেক্ষা ছিল একটা ইস্যুর। সেটা ওয়াকফ আইন সংক্রান্ত প্রতিবাদ জুগিয়ে দিয়েছে। এপারে নিষিদ্ধ একটি সংগঠন, ভুঁইফোড় এক যুব সংগঠন, বাংলাদেশের এক জঙ্গিগোষ্ঠী এবং মহারাষ্ট্রের এক ধর্মীয় সংগঠনের বাছাই করা ‘মাথা’দের নিয়ে গত অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে রীতিমতো ‘সেমিনার’ করে তৈরি হয়েছিল হাঙ্গামার ছক।  হাসিনা উৎখাত পর্বে যেভাবে বাংলাদেশে থানা-পুলিশকে

আক্রমণ, খুন, অস্ত্র লুটপাট, রেল ও সড়ক পথে বিঘ্ন ঘটানো হয়েছিল, সেই একই কায়দায় এপারে হাঙ্গামার প্ল্যান তৈরি হয়। ওপারের এক জঙ্গি সংগঠনের প্রধান ‘রহমানি’র নির্দেশে এপারের এক ‘ক্ষয়িষ্ণু’ রাজনৈতিক দল, নিষিদ্ধ একটি সংগঠন এবং মানবাধিকার রক্ষার তথাকথিত কয়েকজন মাতব্বর ‘গোটা’ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। গোয়েন্দারা বলছেন, ঠিক হয়েছিল, সামশেরগঞ্জ, সূতি ও ধুলিয়ান ছাড়াও জঙ্গিপুর, নিমতিতা ও সাগরদীঘিতে একযোগে ‘হামলা’ চালাতে হবে। ছকে ফেলা হয় পুলিস ও সরকারি কর্মীদের উপর প্রাণঘাতী হামলার পরিকল্পনাও। কিন্তু অসম ও বাংলার এসটিএফ বাংলাদেশের ওই জঙ্গি সংগঠনের এপারের ক্যাডার এবং স্লিপার সেলের সদস্যের বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযান শুরু করায় সেই পরিকল্পনায় ‘ভাটা’ পড়ে। এরপর নয়া ওয়াকফ বিল সামনে আসে। আর ফের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে হাঁটতে শুরু করে এপার এবং ওপারের ‘চক্রী’রা। চলতি এপ্রিল মাসের গোড়ায় ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বসেই সেই পরিকল্পনার ছক

চূড়ান্ত হয়। এপারে নিষিদ্ধ এক সংগঠনের তিন সদস্য, স্বঘোষিত কয়েকজন ‘হুজুর’, মহারাষ্ট্রের ওই ধর্মীয় সংগঠনের ৬ জন সহ মোট ২৫-৩০ জন এক সন্ধ্যায় বৈঠক করে হাঙ্গামার ছক চূড়ান্ত করে। গোয়েন্দারা বলছেন, ‘তাণ্ডব’ পর্ব পরিকল্পনামাফিক চালানোর জন্য বাজেট ধরা হয়েছিল প্রায় ২০ কোটি টাকা। মুর্শিদাবাদের কয়েকজন ‘শুভানুধ্যায়ী’র পাশাপাশি মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ডের পাকুড়, বিহারের কিষানগঞ্জ এবং কয়েকটি এনজিও’র নামে তুরস্ক থেকে আসা টাকা (ভায়া কলকাতা) পৌঁছে যায় ‘হাঙ্গামা তহবিলে’।  গত বৃহস্পতিবার থেকে সামশেরগঞ্জ, সূতি ও ধুলিয়ানের বিভিন্ন প্রান্তে যে হাঙ্গামা ও হামলা শুরু হয়েছিল, তাতে অংশ নিতে দেখা গিয়েছে মুখ ঢাকা এমন বেশ কিছু যুবককে, যাদের পিঠে ‘ব্যাকপ্যাক’ ছিল। সামশেরগঞ্জ, ধুলিয়ান ও সূতির বিভিন্ন প্রান্তে বাছাই করা যে সমস্ত বাড়িতে হামলা ও লুটপাট চালানো হয়েছে, তাতেও ওই যুবকদের অংশ নিতে দেখা গিয়েছে। গোয়েন্দারা বলছেন, এরা ছিল বিহার-ঝাড়খণ্ড এবং বাংলাদেশ থেকে আসা ‘ভাড়া করা লুটেরা’।

ওয়াকফ আইনের বিরোধিতাকে সামনে রেখে এরা দোকান ভেঙে ক্যাশবাক্স ও গৃহস্থ বাড়ির আলমারি ভেঙে টাকা, গয়না ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী লুট করেছে। পাশাপাশি শপিং মল থেকে প্যান্ট-শার্ট, শাড়ি, ইলেকট্রনিক সামগ্রী সহ বহু সামগ্রী তুলে নিয়ে গিয়েছে ওরা। গোয়েন্দারা আরও বলছেন, এই যুবকদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে।  গোয়েন্দারা ইতিমধ্য়েই অন্তত ৫০জনের হদিশ পেয়েছেন যারা হাঙ্গামার ছকের সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে অভিযোগ। প্রায় ৭০টি সন্দেহজনক মোবাইল কলকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে খবর।  কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকায় একটা সময় ছিল যখন নিরাপত্তা বাহিনীকে নিশানা করে পাথর ছোঁড়া হত। মুর্শিদাবাদেও কার্যত একই কায়দা প্রয়োগ করা হয়েছিল। পাথর ছোঁড়ার জন্য় এখানে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা

করে মিলেছে বলে খবর। এমনকী গত দুমাস ধরে এই পাথর জোগাড় করা হয়েছে। জঙ্গিপুর মহকুমার যে অংশে রেলপথ রয়েছে সেখান থেকে দিনের পর দিন ধরে পাথর জোগাড় করা হয়েছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন।  খারিজি মাদ্রাসার পাশাপাশি কিছু বাড়ির ছাদেও মজুত করা হয়েছিল পাথর। রেললাইন থেকে অনেক দূরে সেই পাথরের উপস্থিতি মিলেছে। এলাকায় গুজব ছড়ানোর অভিযোগে এখনও পর্যন্ত ২ হাজার ৯৩টি সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ব্লক করা হয়েছে ৷ তবে ধুলিয়ানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বৈঠকে মুর্শিদাবাদ ও মহারাষ্ট্রের যে ‘চক্রী’রা হাজির হয়েছিল, তাদের কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজন অবশ্য সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের ‘হুজুর’দের কাছে পৌঁছেও গিয়েছে।