ভিন রাজ্যে বাংলা বলার জন্য প্রাণ নিয়ে টানাটানি হবে, কখনও ভাবিনি। কয়েকদিন যে নির্যাতন সহ্য করেছি, নরকযন্ত্রণা বললেও বোধহয় কম। ক্রীতদাসদের সঙ্গেও কি এমন আচরণ করা হয়? দেশের নানা প্রান্ত থেকে বাংলায় কাজ করতে আসেন শ্রমিকরা। কই, তাঁদের তো কখনও এমন নির্যাতনের মুখে পড়তে হয় না? তাহলে বেছে বেছে বাঙালিরাই কেন? কেন্দ্র বলছে আধার বাধ্যতামূলক। অথচ সেসব নথি দেখালে মানতেই চাইছে না ডাবল ইঞ্জিন রাজ্যের পুলিস। বাড়তি উপার্জনের আশায় স্ত্রী, সন্তান ও শ্বশুর, শাশুড়িকে নিয়ে বছরখানেক আগে চাঁচলের মুলাইবাড়ি থেকে গিয়েছিলাম হরিয়ানার গুরুগ্রামে। শ্বশুরের সঙ্গে বিলাসবহুল আবাসনে গাড়ি পরিষ্কারের কাজ নিয়ে বেশ চলছিল। সারা মাসের খরচ বাদ দিয়ে কিছু টাকাও জমিয়েছি। কল্পনা করিনি, শুধুমাত্র বাংলা বলার অপরাধে এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হবে। সেদিন ছিল শুক্রবার। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ঘুমোতে যাব, দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। বেরিয়ে দেখি, কয়েকজন পুলিস দাঁড়িয়ে। একজন রুক্ষ স্বরে বললেন, ‘বাহার আও’। কোথা থেকে এসেছি জিজ্ঞেস করায় বলি বাঙ্গাল সে। সঙ্গে সঙ্গে আধার কার্ড দেখতে চায়। বৈধ পরিচয়পত্র দেখিয়েও লাভ হয়নি। তারা বলে, ১০ মিনিটের জন্য চলো, নথি যাচাই করতে হবে। আমরা ভারতীয়। নির্দ্বিধায় বুক ফুলিয়ে তাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি। যত সময় গড়ায়, পুলিসের অভব্য আচরণ দেখে বুঝতে পারি খুব খারাপ কিছু হতে চলেছে। প্রথমেই নিয়ে যায় অচেনা জায়গায়। মোবাইল কেড়ে, পোশাক খুলিয়ে জানালাবিহীন ছোট্ট, অন্ধকার কুঠুরিতে চালান করে দেয়। শুধু অন্তর্বাস পরেছিলাম। ঘুপচি ঘরে ছিল আরও ন’জন শ্রমিক। শ্বশুরেরও একই অবস্থা। সারারাত অভুক্ত সবাই। মনে হচ্ছিল দম বন্ধ হয়েই মারা যাব। বারবার স্ত্রী, সন্তানদের মুখ ভেসে উঠছিল। পরের দিন এক অফিসার দরজা খোলেন। আমাদের দিয়ে জোর করে ঘর ও বাথরুম পরিষ্কার করানো হয়। বাধ্য করা হয় তাঁদের জুতো মুছতে। তারপর বাদশাপুর থানায় চালান। সেখানেও অনেকে ছিল। কেউই জানত না, অপরাধ কী। খিদের যন্ত্রণা এতটাই যে, ২৪ ঘণ্টা পর দেওয়া দু’টি শুকনো রুটি আর সামান্য ডাল পেয়ে চোখে জল এসে গিয়েছিল। পাঁচদিন সেই থানা চত্বরে কাটিয়েছি অমানবিক পরিশ্রম করে। কাজ না করলেই গালাগাল। অসমের এক নাবালক শ্রমিক হিন্দি বুঝতে না পারায় রাঁধুনির হাতে চড় পর্যন্ত খেয়েছে। কবে ছাড়া হবে? পুলিসকে বারবার জিজ্ঞেস করলে বলে-নথি যাচাইয়ের জন্য তোমাদের রাজ্যে পাঠানো হয়েছে। ই-মেলে তথ্য এলে তবেই ছাড়ব। আমাদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের চেষ্টায় বুধবার রাতে ছাড়া পেয়েছি। থানার বাইরে বেরিয়ে মনে হচ্ছিল, নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলাম। কিন্তু আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না। বৃহস্পতিবার সকালে আবার পুলিস নথি যাচাই করতে আসে। একবার আটক হয়েছি, সব নথি ঠিক আছে বলায় চলে যায়। আতঙ্কে অনেক বাঙালি শ্রমিক গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। আমরাও ফিরব। ট্রেনের টিকিট কাটার প্রস্তুতি চলছে।


