দেশ

বিজেপি শাসিত হরিয়ানায় বাংলা বললেই হেনস্তা, পুলিশের অত্যাচারে গুরুগ্রাম ছাড়ছেন বাঙালিরা

বেসরকারি হাসপাতালকে বাঁদিকে রেখে কিছুটা এগলে একটি সরু গলি। সেই গলি দিয়ে কয়েক কদম হাঁটলে খোলা জায়গা। সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি বড় ট্রাক। তাতে ঠাসা মালপত্র। লোডিংয়ের কাজ শেষ হয়নি। চেয়ার, টেবিল, বিছানা, সেকেন্ড-হ্যান্ড কুলার, এমনকী বাচ্চাদের খেলনা গাড়িও তোলা হচ্ছে ট্রাকে। আজ-কালের মধ্যেই ওই ট্রাক রওনা দেবে বাংলার উদ্দেশে। বিজেপি শাসিত হরিয়ানায় আর একটা রাতও কাটাতে ভরসা পাচ্ছেন না গুরুগ্রাম সেক্টর-৪৯ এর এই বেঙ্গলি মার্কেটের বাসিন্দারা। তাঁদের ‘অপরাধ’ একটিই। প্রত্যেকেই বাংলাভাষী। রাজ্যের বিজেপি সরকারের পুলিস-প্রশাসনের তাই সন্দেহ, তাঁরা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী! হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে। ‘আপনি লুঙ্গি পরেন। তার মানে আপনি বাংলাদেশি।’ কিংবা ‘আপনার বাংলা উচ্চারণ কেমন যেন অন্যরকম। আপনি বেআইনিভাবে ঢুকেছেন কি?’ অথবা ‘ভোটার কার্ড দেখাচ্ছেন বটে। কিন্তু আদৌ ভোটাধিকার আছে তো? ভোট দিতে গ্রামে যান? গ্রাম প্রধানের নম্বর বলুন।’ অভিযোগ, তথ্য যাচাইয়ের নামে এই ধরনের প্রশ্নবাণে বেঙ্গলি মার্কেটের বাসিন্দাদের জর্জরিত করে ফেলছেন পুলিসকর্মীরা। দিনে অন্তত দু’বার তথ্য যাচাইয়ে আসছে পুলিস। জিজ্ঞাসাবাদের নামে থানায় গিয়ে হেনস্তা বা মারধর তো আছেই। সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘হোল্ডিং সেন্টার’। মূলত বাংলাভাষীদের আটকে রাখার জন্যই যা তৈরি হয়েছে। তথ্য যাচাইয়ের নামে দিনের পর দিন সেখানে আটকে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ। আতঙ্কিত বাঙালি তাই হরিয়ানা থেকে পালিয়ে বাঁচার উপায় খুঁজতে মরিয়া হয়েছে। 
কারও বাড়ি দক্ষিণ দিনাজপুরে, কারও বাড়ি নদিয়ায়, কেউ থাকেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদে। সাধারণত প্রান্তিক স্তরের এই বাঙালি পুরুষরা সাফাই কর্মের সঙ্গে যুক্ত। কেউ কেউ সংলগ্ন বিলাসবহুল অভিজাত আবাসনে গাড়ি ধোয়ামোছা করেন। মহিলাদের অধিকাংশই গৃহপরিচারিকা। মোটের উপর নিস্তরঙ্গ জীবনে আচমকাই ঝড় তুলেছে বিজেপি সরকারের পুলিস-প্রশাসনের হেনস্তা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এই আতঙ্ক হিন্দু এবং মুসলমান নির্বিশেষে ছড়িয়েছে গুরুগ্রামে। বেঙ্গলি মার্কেটের বাসিন্দা রাহুল সরকার, কৈলাস রায়, সোহেল রানা, আইনুল হকেরা বললেন, বাচ্চাগুলো স্কুলে পড়ত। ছাড়িয়ে নিয়েছি। বাংলায় ফিরেই ফের স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। শুক্রবার গুরুগ্রামের বেঙ্গলি মার্কেট এলাকায় গিয়ে আতঙ্কের ছবি আরও স্পষ্ট হল। প্রায় তিন হাজার বাঙালি পরিবারের বাস ছিল এখানে। শুক্রবার তা এসে ঠেকেছে তিন থেকে চারটি পরিবারে। দিন দু’য়েকের মধ্যে তাও আর থাকবে না। পাশে থাকা মাস সাতেকের মেয়েকে দেখিয়ে বাসিন্দাদের একজন বললেন, বাচ্চাগুলোর জন্যই ভয় হয় বেশি। এখন শুধু ছেলেদের ধরছে। তুলে নিয়ে যাচ্ছে। মারধর করছে। এরপর বাড়ির মহিলা এবং বাচ্চাদেরও যদি এরা রেহাই না দেয়? অভিযোগ, পুলিস মারধর তো করছেই। এরপর রাতের অন্ধকারে এমন জায়গায় ছেড়ে দিচ্ছে, যেখান থেকে সেক্টর-৪৯’এ বেঙ্গলি মার্কেটের বাড়িতে ফিরতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে ‘আক্রান্ত’দের। হরিয়ানার আতঙ্কিত প্রান্তিক স্তরের বাঙালির একটি বড় অংশ তাই কান মুলছে, আর কখনও এখানে আসব না।