পুজো

ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিনক্ষণ, শুভ সময়!

মূলত কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় দিনে ভাইফোঁটা উদযাপিত হয়। তবে অনেক বাড়িতে রয়েছে কিছু নিয়মভেদ। তাই এটি শুক্লপক্ষের প্রতিপদের দিনও বিভিন্ন জায়গায় উদযাপিত হয় ভাইফোঁটা। ভাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনার উদ্দেশ্যে বোনেরা এই রীতি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। এই উৎসবকে আবার যমদ্বিতীয়াও বলে। কথিত আছে, এই দিন মৃত্যুর দেবতা যম,তার বোন যমুনার হাতে ফোঁটা নিয়েছিলেন। অন্যদিকে শোনা যায়, নরকাসুর নামে এক দৈত্যকে বধ করার পর কৃষ্ণ তাঁর বোন সুভদ্রার কাছে যখন এসেছিলেন। তখন সুভদ্রা তাঁর কপালে ফোঁটা দিয়ে তাকে মিষ্টি খেতে দেন। সেই থেকেই ভাইফোঁটা উৎসবের প্রচলন হয়। এই উৎসব বাঙালিদের কাছে ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া বা ভাই ফোঁটা নামে পরিচিত হলেও, দেশের অন্যান্য রাজ্যে এর রয়েছে ভিন্ন নাম। গোয়া, মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকে এই পার্বণ ‘ভাইবিজ’ নামে পালিত হয়। ভারতের পশ্চিমাংশে এই উৎসব ‘ভাই দুজ’ নামে পালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে ও নেপালে এই উৎসব আবার পরিচিত ভাইটিকা নামে।‌

ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার তিথি

দৃক পঞ্চাঙ্গ পঞ্জিকা অনুযায়ী এ বছর দ্বিতীয়া তিথি শুরু হচ্ছে ১৪ নভেম্বর, মঙ্গলবার দুপুর ২ টো ৩৬ মিনিটে৷ পঞ্জিকা অনুযায়ী ভ্রাতৃদ্বিতীয়া তিথি থাকবে ১৫ নভেম্বর, বুধবার দুপুর ১ টা ৪৭ মিনিট পর্যন্ত৷ ভাইফোঁটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মিষ্টিমুখ ও খাওয়াদাওয়ার পালা৷ ভাইয়ের পছন্দসই খাবার রেঁধে খাওয়ান বোনেরা৷ ভাইবোনের একে অন্যকে উপহার দেওয়াও এই পার্বণের অন্যতম অঙ্গ৷

ভাইফোঁটা ২০২৩ দিনক্ষণ, শুভ সময় 

  • ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া – ১৫ নভেম্বর (২৮ কার্তিক), বুধবার। 
  • প্রতিপদ শুরু – ১৩ নভেম্বর (২৬ কার্তিক), সোমবার, ঘ ২/৩২/২০-এ।
  • প্রতিপদ শেষ – ১৪ নভেম্বর (২৭ কার্তিক) মঙ্গলবার, ঘ ২/২৮/৩০-এ।   
  • দ্বিতীয়া শুরু – ১৪ নভেম্বর (২৭ কার্তিক) মঙ্গলবার, ঘ ২/৩৬/৩১-এ।   
  • দ্বিতীয়া শেষ – ১৫ নভেম্বর (২৮ কার্তিক), বুধবার, ঘ ১/৪৭/ ২৭-এ।  

ভাইফোঁটার মন্ত্র

“দ্বিতীয়ায় দিয়া ফোঁটা, তৃতীয়ায় দিয়া নিতা,
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দই আমার ভাইকে ফোঁটা,  
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।”

ভাই ফোঁটার মন্ত্রেই লুকিয়ে তাঁর পৌরাণিক উৎসের কথা। ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমদুয়ারে পড়ল কাঁটা, যমুনা দেন যমকে ফোঁটা…’ এই মন্ত্রে বলা ঘটনার সূত্র থেকেই ফোঁটা পেয়ে যমরাজের অমর হওয়ার কথা জানা যায়। সেই রীতিই চলে আসছে বাঙালিদের মধ্যে। কিন্তু বাঙালিরা ভাই ফোঁটায় কড়ে আঙুল দিয়ে কেন ফোঁটা দেন জানেন? সনাতন ধর্মের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, মানুষের হাতের ৫টি আঙুল পঞ্চ মহাভূতের প্রতীক। বুড়ো থেকে শুরু করে কড়ে আঙুল পর্যন্ত আঙুলগুলি যথাক্রমে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম এই পাঁচটি ভূতের প্রতিনিধিত্ব করে। অর্থাৎ কড়ে আঙুল ব্যোমের প্রতীক। যার অর্থ মহাশূন্য। শাস্ত্র মতে ভাই ও বোনের সম্পর্ক ভালবাসার ব্যাপ্তি মহাশূন্যের মতোই অসীম। সেই কারণেই প্রতিটি বোন তাঁর ভাই বা দাদার মঙ্গল কামনায় বাঁ হাতের কড়ে আঙুল দিয়েই ফোঁটা দেন।

পুরাণ অনুযায়ী ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার মাহাত্ম্য

পুরাণ অনুযায়ী সূর্য ও তাঁর স্ত্রী সংজ্ঞার দুই সন্তান ছিলেন, যম ও যমুনা। দুই ভাই বোনের মধ্যে গভীর বন্ধন ছিল। যমুনা সবসময় চাইতেন যে যম তাঁর বাড়িতে ভোজনের জন্য আসুক। তবে যমরাজ বোনের অনুরোধ উপেক্ষা করে যেতেন। একদা কার্তিক শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে দুপুর নাগাদ যমরাজ যমুনার বাড়িতে যান। নিজের বাড়িতে যমুনাকে দেখে অত্যন্ত খুশি হন যমুনা। তার পর ভাইকে মন ভরে ভোজন করান যমুনা। যা দেখে যমরাজ অত্যন্ত খুশি হন। বোনের স্নেহ দেখে তাঁরে বর চাইতে বলেন যমরাজ। তখন যমুনা বলেন, যমরাজ যেন প্রতি বছর কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে তাঁর বাড়িতে ভোজন করতে আসেন। আবার যে বোন তাঁর মতো ভাইকে ভালোবাসা ভরে ফোঁটা দেবে তাঁর মন থেকে যমের ভয় মিটে যাবে। তখন যমরাজ বোনকে এই আশীর্বাদই দেন। তার পর থেকেই ভাই ফোঁটার প্রথা শুরু হয়েছে। আবার অন্য মতে, নরকাসুর নামে এক দৈত্যকে বধ করে যখন কৃষ্ণ তাঁর বোন সুভদ্রার কাছে আসেন, তখন সুভদ্রা তাঁর কপালে ফোঁটা দিয়ে তাঁকে মিষ্টি খেতে দেন। তার পর থেকে ভাইফোঁটা চলিত হয়।

ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার লোকাচারের সূত্রপাত

ভাইফোঁটার এই সমস্ত লোকাচারের সূত্রপাত ঠিক কত দিন আগে হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। ‘দীপোৎসবকল্প’-এ বর্ণিত এই ইতিহাস আর কাহিনি যদি সত্যি হয়, তা হলে সেই সূত্র ধরে আমরা ‘ভাইফোঁটা’ উৎসবের সময়কাল আন্দাজ করতে পারি। মহাবীরের মহাপ্রয়াণ ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫২৭ অব্দে। সেই হিসেবে এই উৎসবের বয়স প্রায় আড়াই হাজার বছর। তবে এর প্রাচীনত্বের আভাস পাওয়া যায়, চতুর্দশ শতাব্দীতে ‘সর্বানন্দ সুন্দরী’ নামে এক আচার্য পণ্ডিতের তালপাতার পুঁথি, ‘দীপোৎসবকল্প’ থেকে। জানা যায়, জৈন ধর্মের অন্যতম মহাপ্রচারক মহাবীর জৈনের মহাপ্রয়াণের পর তাঁর অন্যতম অনুগত-সঙ্গী রাজা নন্দিত বর্ধন মানসিক এবং শারীরিক ভাবে খুবই ভেঙে পড়েন।বন্ধ করে দেন খাওয়াদাওয়াও। এই রকম অবস্থায় তাঁর প্রিয় বোন অনসূয়া নন্দিত বর্ধনকে তাঁর নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। দিনটি ছিল কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথি।রাজার কপালে রাজতিলক পরিয়ে বোন অনসূয়া ভাইকে কিছু খাবার খাইয়ে দেন, আর বলেন, ‘রাজ্যের প্রজারা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে, এই অনশন তোমাকে মানায় না। হে ভ্রাতা, হে রাজন, রাজতিলক এঁকে দিলাম তোমার কপালে এবং ক্ষুধা নিরসনের জন্য গ্রহণ করো খাদ্য। সর্ববিধ মঙ্গলের জন্য তুমি জেগে ওঠো, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।’ এর পর রাজা নন্দিত বর্ধন অনশন ভেঙে জীবনসত্যে উদ্ভাসিত হয়েছিলেন।