বিপদতারিনী হলেন হিন্দু দেবী যিনি সঙ্কট থেকে রক্ষা করেন। তিনি দেবী দুর্গা (পার্বতী)-এর একটি রূপ এবং ১০৮ অবতারের মধ্যে অন্যতম। আষাঢ় মাসের রথযাত্রা ও উল্টোরথের মধ্যে মঙ্গল ও শনিবার এই দেবীর ব্রত পালন করা হয়। বাঙালি হিন্দু সমাজে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশায়, এই ব্রত বিশেষভাবে প্রচলিত। দেবী দুর্গার ১০৮টি অবতারের এক অন্যতম রূপ হল বিপত্তারিণী। দেবীকে কখনও দশভুজা রূপে পুজো করা হয়, কখনও আবার চতুর্ভুজা রূপে পুজো করা হয়। দেবী বিপত্তারিণীর উপাসনা করা মানে দেবী দুর্গারই উপাসনা করা। বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করেন সঙ্কটনাশিনী দেবী বিপত্তারিণী। পৌরাণিক কাহিনি মতে, দেবাদিদেব মহাদেব দেবী পার্বতীকে কালী বলে উপহাস করলে দেবী ক্রুদ্ধ হন। দেবী তখন তপস্যাবলে নিজের কৃষ্ণবর্ণ রূপ ত্যাগ করেন। সেই মুহূর্তে দেবী পার্বতীর শরীর থেকেই সৃষ্টি হন দেবী বিপত্তারিণী। দেবী বিপত্তারিণীর উপাসনা করলে সংসারের সকল বাধাবিপত্তি কেটে যায় এবং সংসারের মঙ্গল হয়। আষাঢ় মাসের রথ এবং উল্টোরথের মাঝের মঙ্গল এবং শনিবার দেবী বিপত্তারিণীর ব্রত পালন করা হয়। এবার ২৮ জুন, শনিবার এবং ১ জুলাই, মঙ্গলবার পড়েছে দেবী বিপত্তারিণীর ব্রত। সাধারণত বাড়ির মেয়ে-বৌরা এই ব্রত পালন করে থাকেন। তবে এই ব্রত পালনের নানা নিয়ম রয়েছে। তার মধ্যে প্রথমেই আসে ১৩টা করে সব কিছু নেওয়া। । ব্রতর আচার হিসাবে সব কিছুই ১৩ সংখ্যায় দিতে হয়। অর্থাৎ, ১৩ রকমের নৈবেদ্য সাজাতে হয়। এ ছাড়া লাগে তেরো রকম ফল, তেরো রকম ফুল, তেরোটি পান, তেরোটি সুপুরি, তেরোটি এলাচ। ব্রত পালনের দিন চাল-মুড়ি-চিঁড়ে জাতীয় কোনও জিনিস খাওয়া যায় না। বদলে ১৩টি লুচি ও ফল দেবীর প্রসাদ হিসাবে গ্রহণ করতে হয়। ১৩টি করে সব ব্যবহারের কারণ হিসাবে বিশেষ কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। কথিত রয়েছে, মা বিপত্তারিণীর পছন্দের সংখ্যা হল ১৩। সে কারণেই এই পুজোয় দেবীর কাছে সমস্ত জিনিস ১৩টি করে অর্পণ করা হয়। শাস্ত্রমতে, ১৩ সংখ্যাটি ব্যবহার করলে দেবীর আশীর্বাদ লাভ করা যাবে। এতে যে কোনও বিপদ থেকে দেবী আমাদের রক্ষা করবেন। ১৩ সংখ্যাটিকে দেবী বিপত্তারিণীর আশীর্বাদ ও সুরক্ষার প্রতীক মনে করা হয়।
বিপত্তারিণী ব্রত পালনে কী কী লাগে?
ঘট, আম্র পল্লব, শীষ সহ ডাব, একটি নৈবেদ্য, ১৩ টি গিঁট দেওয়া লাল সুতো (সঙ্গে ১ত টি দূর্বা বাঁধা), ১৩ রকম ফুল, ১৩ রকম ফল, ১৩ গাছি লাল সুতো, ১৩টি দূর্বা, ১৩টি পান ও ১৩টি সুপুরি।
- এই ব্রত সাধারণত মহিলারা পালন করেন, স্বামী, সন্তান ও পরিবারের মঙ্গল কামনায়।
- দেবীকে উৎসর্গ করার জন্য ১৩টি ফল, ১৩ রকম ফুল, ১৩টি পান, ১৩টিসুপারি, প্রদীপ, ধূপ ইত্যাদি ১৩টি করে দেওয়া হয়।
- এই ব্রত পালনের মাধ্যমে জীবনে আসা সমস্ত বিপদ দূর হয় বলে বিশ্বাস করা হয়।
বিপত্তারিণী পুজোয় লাল রঙের তাগা বাঁধা হয় –
বিপত্তারিণীর পুজো শেষে হাতে লাল তাগা বাঁধার চল রয়েছে। মেয়েরা এই তাগা বাঁ হাতে পরেন আর ছেলেরা ডান হাতে পরেন। সেই তাগাতেও ১৩টি গিঁট বাঁধা হয়। সেই ১৩টি গিঁটে দেবী দুর্গার ১৩টি রূপে বিরাজ করেন বলে বিশ্বাস করা হয়। ১৩টি গিঁট ছাড়াও তাতে ১৩টি দূর্বাঘাস বাঁধা হয়। এই তাগা অনেকে সারা বছর ধরে পরে থাকেন, অনেকে আবার তিন দিন পরার পর নদী বা পুকুরের জলে ভাসিয়ে দেন। বিশ্বাস করা হয় যে, এই তাগা হাতে পরলে বিপদ কোনও দিন আপনাকে স্পর্শ করতে পারবে না। মা বিপত্তারিণীর আশীর্বাদ সর্বদা আপনার সঙ্গেই থাকবে।
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুসারে –
১৩ আষাঢ়, ২৮ জুন, শনিবার ।
তিথি— (আষাঢ় শুক্লপক্ষ) তৃতীয়া সকাল ৯টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত, পরে চতুর্থী।
১৬ আষাঢ়, ১ জুলাই, মঙ্গলবার।
তিথি— (আষাঢ় শুক্লপক্ষ) ষষ্ঠী সকাল ১০টা ২১ মিনিট পর্যন্ত, পরে সপ্তমী।
গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা মতে –
১৩ আষাঢ়, ২৮ জুন, শনিবার ।
তিথি— (আষাঢ় শুক্লপক্ষ) তৃতীয়া সকাল ১২টা ২১ মিনিট ১২ সেকেন্ড পর্যন্ত, পরে চতুর্থী।
১৬ আষাঢ়, ১ জুলাই, মঙ্গলবার।
তিথি— (আষাঢ় শুক্লপক্ষ) ষষ্ঠী সকাল ১২টা ২৭ মিনিট ৫ সেকেন্ড পর্যন্ত, পরে সপ্তমী।
বিপদতারিনী মন্ত্র:
১) “নমঃ সর্বমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী নারায়ণী নমস্তুতে।”
২) মাসি পূন্যতমেবিপ্র মাধবে মাধবপ্রিয়ে। ন বম্যাং শুক্লপক্ষে চ বাসরে মঙ্গল শুভে। সর্পঝক্ষে চ মধ্যাহ্নে জানকী জনকালয়ে। আবির্ভূতা স্বয়ং দেবীযগেষু শোভনেষুচ। নমঃ সর্ব মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরী নারায়ণী নমস্তুতে।।