পুর পরিষেবার গাফিলতি ও ফাঁক নিয়ে কড়া মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার নবান্নের বৈঠকে রীতিমতো ‘বকাবকি’ করতেও ছাড়লেন প্রশাসনিক সতীর্থদের। তীব্র ক্ষোভপ্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন বলেন তাঁর টার্গেটে রয়েছেন একাধিক পুরসভার চেয়ারম্যানরা। ক্ষোভের রেশ থেকে বাদ গেলেন না মন্ত্রীরাও। বিধাননগর পুরনিগমে ইচ্ছমতো লোক বসানো হচ্ছে বলে নাম করেই সুজিত বসুর বিরুদ্ধে অভিযোগ উগরে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেন, ”সুজিত বসু লোক বসিয়ে দিছে। সল্টলেকের কাউন্সিলররা কোনও কাজ করে না।যেখান সেখান থেকে লোক এনে পুরসভায় কাজ দিচ্ছে। যেখানে সেখানে দোকান বসে যাচ্ছে অনুমতি ছাড়াই।” পুর পরিষেবা নিয়ে বিরক্ত মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন, “এবার কি আমাকে রাস্তায় ঝাঁটা দিতে হবে?” একইসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “কারও কারও অভ্যাস হয়ে গিয়েছে যতদিন আইসি, জেলাশাসক, এসডিও থাকব, কিছু গুছিয়ে নেব।” ক্ষুব্ধ মমতা এদিন আরও বলেন, “বিধাননগর, নিউটাউনে বেআইনি নির্মাণগুলিতেও কী করে বিদ্যুৎ-এর লাইন পেয়ে যাচ্ছে?” এর ফলে কিছু কিছু অসৎ ব্যবসায়ীরা ‘প্রোটেকশন’ পেয়ে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “রাস্তা দখল বেড়েই যাচ্ছে। পুরসভা তো চোখ দিয়ে দেখেই না। পুলিশ তো দেখে না। আমি বললে সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ করে সাত দিন ধরে আমাকে দেখানোর জন্য। যারা বিদ্যুৎ এর টাকা দেবে না তাঁদের টাকাই বন্ধ করে দেব।” এই প্রসঙ্গে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের নাম শোনা যায় মুখ্যমন্ত্রীর মুখে। তিনি বলেন, “শট সার্কিট হচ্ছে খুব বেশি। অরূপ, এটা ঠিকভাবে দেখতে হবে। পুরসভাগুলি টাকা খেতে ব্যস্ত।” মানুষ যদি পরিষেবা না পায় তাহলে পুরসভা ও পঞ্চায়েত রাখার মানে কী! টাকার বিনিময়ে কিছু লোক কাজ করছে। কেউ টাকা খেয়ে বা খাইয়ে এসব করছে। এভাবে টাকার বিনিময়ে কাজে নষ্ট হচ্ছে রাজ্যের ভাবমূর্তি। সোমবার নবান্নের সভাগৃহে পুরসভার মেয়র-চেয়ারম্যানদের উদ্দেশে কড়া নিদান দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সাফ কথা, পরিষেবা দিতে না পারলে সরে যান। আমার কথা তিক্ত লাগলেও কিছু করার নেই। আমি কিছুতেই বাংলার বদনাম করতে দেব না। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, আমি মানুষকে ভালবাসি। মানুষকে যাঁরা ভালবাসে না, তাঁদের ছুঁড়ে ফেলতে দু’বার ভাবব না। সরকার কারও জন্য কোনও বদনাম নেবে না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, পুরসভা পঞ্চায়েত মানুষকে জনসেবাটা দেয়। কিন্তু কিছুদিন ধরেই দেখছি নানা সমস্যা। টাকার বিনিময়ে কিছু লোক কাজ করছে। তাতে রাজ্যের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। রথীন চেয়ারম্যান থাকাকালীন হাওড়ার বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও হাওড়াতে তো বিধায়ক-মন্ত্রীরা রয়েছেন। তাঁরা কী করছেন? অ্যাম্বুল্যান্স ঢোকার জায়গা নেই, বেআইনি নির্মাণ হচ্ছে। জবরদখল মুক্ত করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না কেন? সেই প্রশ্নও ছুঁড়ে দিলেন তিনি। তারপর বলেন, হাওড়ায় জঞ্জাল সাফাইয়ের কোনও বন্দোবস্ত নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ট্রিট লাইট জ্বলে যাচ্ছে। কলের জল পাইপ দিয়ে পড়ে যাচ্ছে তো পড়েই যাচ্ছে। ভ্যাটগুলো নোংরা হয়ে থাকে, একবারও কেউ দেখেন না। টাকা দেওয়া সত্ত্বেও কেন জঞ্জাল সাফাই হয় না? মুখ্যমন্ত্রীর সাফ কথা, বহু জায়গায় নোংরা জল মিশে যাচ্ছে। মানুষের জীবনের থেকে দামি কিন্তু কিছু নয়। আপনারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছেন না। তিনি বলেন, টাকার জন্য পুরসভার বহু জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। টাকা খেয়ে দেদার বেনিয়ম হচ্ছে। হাওড়া পুলিশকে বলব তদন্ত করার জন্য। শুধু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই নন, আমলা থেকে পুলিশ কর্তা অনেকেই জড়িত। আমি জানতে চাই না কে করেছে, কিন্তু এসব কমাতে হবে। লোভ সংবরণ করতে হবে। অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করছে না, সরকারের জমি বেচে দিচ্ছে। পুরসভাগুলি ইচ্ছামতো টেন্ডার ডাকছে। জিজ্ঞাসা না করে কর বাড়াচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, হাওড়া শহরটাকে সুন্দর করে গড়ে দিয়েছি, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না। অ্যাডেড এরিয়াতে প্রপার প্ল্যানিং নেই। নিকাশি, ড্রেন পরিষ্কার করা হচ্ছে না। দু-তিনমাস জলের তলায় থাকছে হাওড়া। তাঁর কথায়, হাওড়া পুরসভায় এই মুহূর্তে বোর্ড নেই, এসডিও দেখেন। চারজন এমএলএ তার সুযোগ নিচ্ছে। ডিএমকে বলেন, আপনার এসডিও ভাল কাজ করছে না। আগে সব দুর্নীতি সাফ করব, তারপর ইলেকশনে যাব। এরপরই তিনি কড়া পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, টেন্ডার আর লোকালি করতে দেব না। সব টেন্ডার কেন্দ্রীয়ভাবে হবে। এই মর্মে মুখ্যসচিবকে মাথায় রেখে একটি কমিটি তৈরি করে দেন তিনি। শুধু তাই নয়, স্বচ্ছতা যাচাই করতে রিভিউ কমিটি তৈরির কথাও জানান মুখ্যমন্ত্রী। কে কেমন পারফরম্যান্স করছে, তা দেখেই ব্যবস্থা। এদিন উলুবেড়িয়ার উদাহরণ তুলে ধরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, উলুবেড়িয়া যদি করতে পারে, আপনারা করতে পারেন না কেন? শিলিগুড়ি, রায়গঞ্জ, বিধাননগর, আলিপুরদুয়ার, কাঁথি, পানিহাটি, হাওড়া, হলদিয়া, ডালখোলা, কুপার্স ক্যাম্প পুরসভাকে এদিন সতর্ক করে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সাফ কথা, কোনও অবহেলা শুনব না, পারফরম্যান্স করতে হবে। মানুষ পরিষেবা পাবে না, তা চলবে না। প্রয়োজনে আগামী দিন কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। লোভ করলে মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগানোর নিদান দেন তিনি। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, আমি টাকা তোলার মাস্টার চাইছি না, জনসেবক চাইছি।