কলকাতা রাজনীতি

অভিষেকের নির্দেশে বিএলও’র ছায়াসঙ্গী বিএলএ, রাজ্যজুড়ে ‘ওয়ার রুম’

এসআইআর বা ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন পর্বকে ঘিরে তৃণমূল কংগ্রেসের তৎপরতা এখন তুঙ্গে ৷ শুক্রবার ভার্চুয়াল বৈঠকে রাজ্যের সবস্তরের সংগঠনকে এই প্রক্রিয়া নিয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশ দিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ সূত্রের খবর, বৈঠকে রাজ্য, জেলা ও ব্লক স্তরের হাজার হাজার নেতা ও জনপ্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন ৷ এই বৈঠকে অভিষেক ঘোষণা করেন, রাজ্যের প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রের জন্য মোট 294টি ‘ওয়ার রুম’ খোলা হবে ৷ এই ওয়ার রুমের তদারকি করবেন সংশ্লিষ্ট এলাকার বিধায়করা ৷ যেখানে বিধায়ক নেই, সেখানে দায়িত্ব সামলাবেন ব্লক সভাপতি ৷ তিনি পরিষ্কার নির্দেশ দিয়েছেন, প্রতিটি ওয়ার রুমে পর্যাপ্ত ল্যাপটপ, স্থিতিশীল ইন্টারনেট সংযোগ এবং কম্পিউটার-অভিজ্ঞ অন্তত চার থেকে পাঁচজন কর্মী রাখতে হবে ৷ ভোটার তালিকার এই নিবিড় সংশোধন (SIR) প্রক্রিয়ায় ৪ নভেম্বর থেকে বুথ লেভেল আধিকারিক বা বিএলও (BLO)-রা বাড়ি বাড়ি যাবেন ভোটারদের তথ্য যাচাই করতে ৷ আর তাঁদের সঙ্গে থেকে প্রতিটি ফর্ম পূরণের কাজে তদারকি করবেন দলের বুথ স্তরের এজেন্ট বা বিএলএ-টু (BLA 2) ৷ তৃণমূল সাংসদ অভিষেকের নির্দেশ, 3 নভেম্বরের মধ্যে সমস্ত বিএলএ-টু-র চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করে প্রায় ৮০ হাজার ফর্ম নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দিতে হবে ৷ অভিষেকের কথায়, “99 শতাংশ নয়, 100 শতাংশ এনুমারেশন ফর্ম পূরণ করার দায়িত্ব নিতে হবে বিএলএদের ৷ একজনও প্রকৃত ভোটারের নাম যেন বাদ না-যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে ৷” তিনি আরও জানান, প্রতিটি ওয়ার্ডে সকাল 9টা থেকে বিকেল 5টা পর্যন্ত ক্যাম্প খুলে রাখতে হবে ৷ ওই ক্যাম্প থেকে বিএলওদের যাবতীয় কাজ পর্যবেক্ষণ করা হবে ৷ “বিএলওদের এক মিনিটের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেওয়া যাবে না”, বলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ৷

‘গাছাড়া মনোভাব চলবে না’- কড়া বার্তা অভিষেকের

বৈঠকে দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে তিনি সতর্ক বার্তা দেন, “বিএলএ-র কাজ হল বিএলও-র ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকা ৷ এর মানে এই নয়, সকালে দু’ঘণ্টা রইলাম, তারপর দুপুরে খেতে বাড়ি গেলাম ৷ গাছাড়া মনোভাব চলবে না ৷ আগামী ছ’মাস আমাদের অ্যাসিড টেস্ট ৷ এই সময়ে এক মুহূর্তের জন্যও ঢিলেমি চলবে না ৷” তিনি জানান, প্রতিটি স্তরে পর্যবেক্ষণের জন্য বিএলএ, বিআরএস (BRS), ডিএলএ এবং ইআরও- এই চার স্তরের মধ্যে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতে হবে ৷ বিএলএ যদি কোনও সমস্যায় পড়েন, তা অবিলম্বে উপরের স্তরে জানাতে হবে ৷

হেল্পলাইন চালু, বাড়ছে নজরদারি

ভোটার তালিকা সংশোধনের প্রক্রিয়ায় কেউ সমস্যায় পড়লে যাতে তৃণমূলের কর্মীরা সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন, সে জন্য দলের তরফে এদিনই একটি বিশেষ হেল্পলাইন নম্বর চালু করা হয়েছে- 8142681426 ৷ অভিষেকের স্পষ্ট বক্তব্য, “কমিশনকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি ভোটার তালিকায় চুপি চুপি কারচুপি করতে চাইছে ৷ একজনও বৈধ ভোটারের নাম বাদ না যায়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য ৷ এই জন্যই প্রতিটি বুথে বিএলএদের মাঠে নামানো হচ্ছে ৷”

ভোটার তালিকা ঘিরে ক্রমবর্ধমান অভিযোগ

তৃণমূলের দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ, ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে বাংলার প্রকৃত ভোটারদের নাম পরিকল্পিতভাবে বাদ দেওয়া হচ্ছে ৷ বৃহস্পতিবার তৃণমূল ভবনে সাংবাদিক বৈঠকে দলের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য ও রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ অভিযোগ করেন, ২০০২ সালের ভোটার তালিকার হার্ড কপির সঙ্গে 2025 সালের কমিশনের তালিকার মধ্যে ‘বিস্ময়কর গরমিল’ পাওয়া গিয়েছে ৷ তাঁদের দাবি, একাধিক বুথে পুরনো তালিকায় থাকা নাম আজ সম্পূর্ণভাবে উধাও ৷

দলের তরফে নির্দিষ্ট এলাকার উদাহরণ তুলে ধরে অভিযোগ করা হয়— “এসআইআর-এর নাম করে বেছে বেছে নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে ৷” ফলে এই পর্যায়ে কোনও গাফিলতি বরদাস্ত করতে রাজি নন অভিষেক ৷

আতঙ্কের আবহ ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

এসআইআর ঘোষণার পর থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে ৷ ইতিমধ্যে আগরপাড়া, ইলামবাজার ও দিনহাটায় মর্মান্তিক ঘটনায় তৃণমূল অভিযোগ করেছে, “এসআইআর আতঙ্কে মানুষ এই পথ বেছে নিচ্ছেন” ৷ শুক্রবারের বৈঠকে অভিষেক জানান, টিটাগড়ে কাকলি সরকার নামে আরও এক মহিলা একই কারণে নিজেকে শেষ করেছেন বলে খবর এসেছে ৷ তিনি কর্মীদের সতর্ক করে বলেন, “মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে দেবেন না ৷ প্রতিটি এলাকায় মানুষের পাশে দাঁড়ান ৷”

সংগঠনে বার্তা — ‘বাংলার ভোটাধিকার রক্ষাই এখন একমাত্র লক্ষ্য’

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ভার্চুয়াল বৈঠক কার্যত দলীয় সংগঠনের নতুন ‘কমান্ড সেন্টার’-এর ইঙ্গিত দিয়েছে ৷ তাঁর কথায়, “এই লড়াইটা ভোটের নয়, ভোটাধিকার রক্ষার লড়াই ৷ কমিশন ও বিজেপি যদি প্রকৃত ভোটারদের নাম বাদ দিতে চায়, তাহলে প্রতিটি বুথ থেকেই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে ৷” রাজ্যজুড়ে এখন তাই শাসক দলের প্রধান লক্ষ্য— একজনও যোগ্য ভোটার যেন তালিকা থেকে বাদ না পড়েন ৷